প্রিয় পাঠক, প্রথম আলোয় নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে আপনাদের লেখা। আপনিও পাঠান। গল্প-কবিতা নয়, বাস্তব অভিজ্ঞতা। আপনার নিজের জীবনের বা চোখে দেখা সত্যিকারের গল্প; আনন্দ বা সফলতায় ভরা কিংবা মানবিক, ইতিবাচক বা অভাবনীয় সব ঘটনা। শব্দসংখ্যা সর্বোচ্চ ৬০০। দেশে থাকুন কি বিদেশে; নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বরসহ পাঠিয়ে দিন এই ঠিকানায়: readers@prothomalo.com
এ বছর জুলাই মাসে ভাইঝির বিয়ে উপলক্ষে গিয়েছিলাম ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টারে। আমার ভাই পেশায় চিকিৎসক আর নেশায় ভ্রমণবিলাসী। প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো দর্শনীয় স্থানে ঘুরতে নিয়ে যেতেন। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী ছিলাম। অনেকটা সে কারণেই শেক্সপিয়ারের জন্মস্থান ভ্রমণ ছিল আমার আগ্রহের তালিকার শীর্ষে। ইংল্যান্ডের জাতীয় কবি, সর্বযুগের শ্রেষ্ঠ নাট্যকার, ‘বার্ড অব অ্যাভন’ নামে খ্যাত উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের জন্মস্থান ওয়ারউইকশায়ারের স্ট্র্যাটফোর্ড-আপন-অ্যাভন শহরে। পর্যটকে সর্বদা মুখর থাকে এই বাজারশহর। এখানেই শেক্সপিয়ার রচনা করেছেন তাঁর অমর সাহিত্যের সিংহভাগ।
এক রৌদ্রকরোজ্জ্বল সকালে আমরা গেলাম স্ট্র্যাটফোর্ড–আপন–অ্যাভনে। শহরের মাঝখানে কালো পাথরে যুবক শেক্সপিয়ারের ভাস্কর্য। ভাস্কর্যের বেদিতে দাঁড়িয়ে কয়েকটি ছবি তুলে এগোলাম শেক্সপিয়ার সেন্টারের দিকে। শেক্সপিয়ারের মৃত্যুর পর তাঁর সম্পত্তি ও অন্যান্য মূল্যবান সামগ্রী রক্ষার জন্য একটি ট্রাস্ট গঠন করা হয়। ট্রাস্ট তাঁর সম্পত্তি অধিগ্রহণের প্রায় ১০০ বছর পর ১৯৬৪ সালে হেনলি স্ট্রিটে শেক্সপিয়ার সেন্টার স্থাপিত হয়। সেন্টারের ভেতরে ঢুকতে হলে সরাসরি বা অনলাইনে ২০ পাউন্ড দিয়ে টিকিট কিনতে হয়। টিকিটের মেয়াদ এক বছর।
প্রথমেই ঢুকলাম প্রদর্শনী কক্ষে। শেক্সপিয়ারের পরিবারের বংশলতিকার সামনে এসে দাঁড়ালাম। শেক্সপিয়ারের পিতা জন শেক্সপিয়ার, মা মেরি আর্ডেন। শেক্সপিয়ার আট ভাইবোনের মধ্যে তৃতীয়। ১৫৬৪ সালের ২৩ এপ্রিল তাঁর জন্ম। শেক্সপিয়ারের সব ট্র্যাজেডি, কমেডি ও ঐতিহাসিক নাটকের সংকলন ‘ফার্স্ট ফোলিও’ সংরক্ষিত আছে এখানে। দেয়ালে ঝুলছে সে সময়ের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার চিত্র। দেয়াললিখনে তাঁর বিখ্যাত সব নাটকের উক্তিগুলো। সংরক্ষিত আছে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ নথি, চিত্র ও দলিল।
প্রদর্শনী কক্ষ থেকে বের হয়ে ছোট বাগান ধরে একটি দোতলা বাড়ি। পাথর ও ওক কাঠের তৈরি। শেক্সপিয়ারের পুরোনো পারিবারিক বাড়ি এটি। কয়েকটি কক্ষের মধ্যে একটি পিতা জন শেক্সপিয়ারের কাজের ঘর। জন ছিলেন পশম ব্যবসায়ী। বিভিন্ন প্রকার গ্লাভস বা দস্তানা এবং তথ্য ও তালিকা প্রদর্শনীর জন্য সাজিয়ে রাখা হয়েছে। একজন গাইড গ্লাভস–সম্পর্কিত তথ্য বর্ণনা করছেন।
এরপর কিছুটা সংকীর্ণ সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলাম দোতলায়। কী নিপুণভাবে প্রায় ৫০০ বছর আগের বাড়িটিকে অবিকল সে রকম রাখার চেষ্টা করা হয়েছে! শেক্সপিয়ারের বিছানা, পোশাকাদি, শিশুকালের ছোট জুতাজোড়া, পড়ালেখার চেয়ার–টেবিল, পাখির পালকের মধ্যে বিশাল লম্বা কলম—সব সাজানো আছে এখানে। ডাইনিং টেবিলে সাজানো সকালের নাশতা। পাশে সেই আমলের ফায়ারপ্লেস। খাবারের ধরন ও অন্যান্য অনুষঙ্গ দেখে ধারণা করা যায়, অভিজাত জীবনযাপন ছিল তাঁদের। শেক্সপিয়ারের পিতা ব্যবসার পাশাপাশি সে অঞ্চলের মেয়রের দায়িত্বও পালন করেছেন। পাশের কক্ষটি শেক্সপিয়ারের আঁতুড়ঘর। এখানেই জন্মেছিলেন এই মনীষী।
দোতলা থেকে নেমে এলাম শেক্সপিয়ারের বাগানে। পরিপাটি, ছিমছাম বাগানের এক প্রান্তে যেতেই বিমুগ্ধ বিস্ময়ে দেখলাম, পাথরের তৈরি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি আবক্ষ মূর্তি! পাশে একটি ফলকে লেখা এখানে এই মূর্তি স্থাপনের ইতিহাস। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৬ সালে শেক্সপিয়ারের প্রশংসা করে একটি কবিতা লিখেছিলেন। কবিতাটি তিনি ইংরেজিতে অনুবাদও করেন। ১৯৬৪ সালে শেক্সপিয়ারের ৪০০তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ভারতীয় দূতাবাসের উদ্যোগে মূর্তিটি এখানে স্থাপন করা হয়। পাশেই একটি স্তম্ভমূলে কবিতাটির বাংলা ও ইংরেজি অনুবাদ খোদাই করা।
বাগানের আরেক প্রান্তে গিয়ে দেখি, দর্শকের এক বড়সড় জটলা। কাছে যেতেই যা দেখলাম, তাতে আমার মনময়ূরী আনন্দে নেচে উঠল। একটি বড় বেদির ওপর দুজন সুদর্শন তরুণ অভিনেতা ও অভিনেত্রী শেক্সপিয়ারের রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট নাটকের অংশবিশেষ অভিনয় করছেন। অসাধারণ অভিনয়! অভিনয় শেষে তাঁরা দুজন দর্শকদের অভিবাদন জানালেন। দর্শকেরা এগিয়ে যাচ্ছেন তাঁদের সঙ্গে ছবি তুলতে। আমিও এগিয়ে গেলাম। আবেগ ও আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে হাত বাড়িয়ে বললাম, ‘মাই রোমিও! মাই জুলিয়েট!’ সন্তানসম দুই অভিনেতা–অভিনেত্রী আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুললেন। কিছু আনন্দময় স্মৃতি রচিত হলো নিমেষেই। অভিনয়ের এই অংশ দেখতে পাওয়া আসলে একটি বাড়তি পাওনা। কারণ, প্রতিদিন শুধু একটি নির্দিষ্ট সময়েই এটি মঞ্চস্থ হয়।
এবার ফেরার পালা। কিছু স্মৃতিচিহ্ন কিনে মধুর স্মৃতি আর অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে বেরিয়ে এলাম স্ট্র্যাটফোর্ড-আপন-অ্যাভনের ব্যস্ত লোকালয়ে।