বিশ্ব পরিবেশ দিবস

অভিযান-মামলায় থামছে না প্যারাবন দখল, ঝুঁকিতে জীববৈচিত্র্য

কক্সবাজারের মহেশখালীর হোয়ানকে উপকূলীয় প্যারাবন নিধন করে চিংড়িঘের তৈরির প্রস্তুতি। গত শনিবার দুপুরে
ছবি: প্রথম আলো

কক্সবাজারের সাগরদ্বীপ মহেশখালীতে উপকূল রক্ষার প্যারাবন (ম্যানগ্রোভ) উজাড় করে চিংড়িঘের তৈরির হিড়িক পড়েছে। গত পাঁচ মাসে উপজেলার শাপলাপুর, হোয়ানক ও কুতুবজুম ইউনিয়নের অন্তত ৪০০ একরের প্যারাবন উজাড় করে ২৩টির বেশি চিংড়িঘের তৈরি হয়েছে। এতে জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের পাশাপাশি পরিবেশেরও মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। কিছু বনকর্মীর যোগসাজশে স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা এই দখলে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে।

মহেশখালীতে উপকূলীয় বন বিভাগের গোরকঘাটা রেঞ্জের আওতায় সাতটি বিটের অধীন ৪২ হাজার ২৯৪ একর প্যারাবন (বনভূমি) রয়েছে। এর মধ্যে বন বিভাগের দখলে আছে ৩৭ হাজার ১৯৮ একর। বন বিভাগের তথ্য বলছে, অবশিষ্ট ৫ হাজার ৯৬ একর বনভূমি গত ১০ বছরে দখলে রেখেছেন ৯৩০ জন প্রভাবশালী ব্যক্তি। এ সময় কাটা হয়েছে প্রায় ৯ লাখ বাইন ও কেওড়াগাছ।

এ প্রসঙ্গে উপকূলীয় বন বিভাগের চট্টগ্রাম বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) আবদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, দুই মাস আগেও বিশেষ অভিযান চালিয়ে হোয়ানকের তিনটি চিংড়িঘেরের বেড়িবাঁধ কেটে দিয়ে বনভূমি দখলমুক্ত করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে বনভূমি আবার বেদখলে চলে গেছে। বিট অফিস থেকে প্যারাবনের দূরত্ব ২০ থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে। প্যারাবন দখলের খবর পেলেও বনকর্মীদের তাৎক্ষণিকভাবে অভিযান চালানো সম্ভব হয় না। প্যারাবন রক্ষা করতে হলে জনবল বৃদ্ধির পাশাপাশি আশপাশেই বন কার্যালয় স্থাপন করতে হবে।

প্যারাবন নিধনের ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) মহেশখালী উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক আবু বক্কর ছিদ্দিক বলেন, প্যারাবন উজাড়ের ফলে একদিকে উপকূল বিলীন হচ্ছে, অন্যদিকে জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে। গাছপালা উজাড় হওয়ায় পরিযায়ী পাখির আবাসস্থল, পশুপাখির বিচরণক্ষেত্র ধ্বংস হচ্ছে।

৩ চিংড়ি ঘেরেই বনের ক্ষতি সাড়ে ২২ কোটি

গত শনিবার দুপুরে মহেশখালীর গোরকঘাটা থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে হোয়ানক ইউনিয়নের কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, কয়েক শ একরের প্যারাবন ধ্বংস করে সেখানে পাঁচ থেকে ছয়টি চিংড়িঘের নির্মাণ হয়েছে। ঘেরের ভেতরে দাঁড়িয়ে আছে কেটে ফেলা বাইন ও কেওড়াগাছের মোথা (গোড়ালি)। সমুদ্রের লোনাপানি ঢুকিয়ে সেখানে চিংড়ি চাষ হবে।

ইউনিয়নের বগাচর এলাকায় বিশাল প্যারাবন দখল করে চিংড়িঘের করেন স্থানীয় প্রভাবশালী এরশাদ উল ইসলামের নেতৃত্বে ১০ থেকে ১২ জন। স্থানীয় কয়েক বাসিন্দা জানান, আড়াই মাস আগে ১০০ একরের প্যারাবনের প্রায় দেড় লাখ বাইনগাছ কেটে চিংড়িঘেরটি করা হয়।

প্যারাবন উজাড়ের ফলে একদিকে উপকূল বিলীন হচ্ছে, অন্যদিকে জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে। গত শনিবার মহেশখালীর হোয়ানকে

স্থানীয় মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এরশাদের ঘেরের দক্ষিণে অমাবস্যাখালীর আন্ধারঘোনা এলাকায় প্যারাবন নিধন করে চিংড়িঘের করেন স্থানীয় শাহাব উদ্দিনসহ কয়েকজন। তাতে কাটা হয় অন্তত এক লাখ বাইনগাছ। পাশের আরও ৫০ থেকে ৬০ একর প্যারাবন দখল করে আরেকটি চিংড়িঘের নির্মাণ করেন মোহাম্মদ সিকদারসহ কয়েকজন। এতেও প্রায় এক লাখ গাছ নিধন করা হয়। শত শত শ্রমিক নিয়োগ করে প্রকাশ্যে খননযন্ত্র দিয়ে প্যারাবন নিধন ও চিংড়িঘেরের বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হলেও কেউ বাধা দেয়নি।

এ বিষয়ে জানতে এলাকায় যোগাযোগ করেও তিন দখলদারের কাউকে পাওয়া যায়নি। এরশাদ ও সিকদারের মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া যায়। শাহাব উদ্দিন ফোন ধরেননি।
উপকূলীয় বন বিভাগের গোরকঘাটা রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. আয়ুব আলী বলেন, তিনটি চিংড়িঘের করতে গিয়ে এরশাদ উল ইসলাম, মোহাম্মদ শাহাব উদ্দিন ও মোহাম্মদ সিকদার প্রায় ৩০০ একর প্যারাবন ধ্বংস করেছেন। তাতে কয়েক লাখ বাইনগাছ কেটে ফেলা হয়েছে। তিনটি চিংড়িঘ নির্মাণের বিপরীতে বন বিভাগের ক্ষতি হয়েছে ২২ কোটি ৬১ লাখ ৭৭ হাজার ৯২০ টাকা।

এ ঘটনায় এরশাদ উল ইসলাম, মোহাম্মদ শাহাব উদ্দিন, মোহাম্মদ সিকদারসহ ১৭০ জনের বিরুদ্ধে মহেশখালী থানায় পৃথক চারটি মামলা হলেও দখলদারদের কাউকে গ্রেপ্তার হননি। আসামিরা প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়া দেওয়ায় চিংড়িঘেরগুলো উচ্ছেদ করা যাচ্ছে না।

বন বিভাগের তথ্যমতে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে উপকূলকে রক্ষার জন্য ১৯৯৮ থেকে ২০০০ সালে হোয়ানক ইউনিয়নে ৩০০ একর প্যারাবনে প্রায় পাঁচ লাখ বাইন ও কেওড়াগাছ সৃজন করা হয়। প্যারাবনের আশপাশে বেশ কয়েকটি চর জেগে ওঠে। সেখানেও প্যারাবন সৃজিত হয়। গাছগুলোর উচ্চতা এখন ১২ থেকে ২৫ ফুট। কয়েক মাস ধরে গাছগুলো কেটে সেখানে চিংড়িঘের নির্মাণ করা হচ্ছে।

বন বিভাগের কর্মকর্তারা বলেন, প্যারাবন উজাড়ের ঘটনায় সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে সম্প্রতি বড়দিয়া বন বিটের বনপ্রহরী আবদুর রাজ্জাক ও ঝাপুয়া বিটের বনপ্রহরী খলিলুর রহমানকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়। একই অভিযোগে গোরকঘাটা রেঞ্জ কর্মকর্তা এস এম আনিসুর রহমান, ঝাপুয়া বিট কর্মকর্তা মোহাম্মদ মাহাবুবুল হক ও একজন নৌকাচালককে অন্যত্র বদলি করা হয়।

মামলার আসামিরা গ্রেপ্তার হয়নি, থেমে নেই দখল

স্থানীয় লোকজন জানান, এরশাদ উল ইসলাম, মোহাম্মদ শাহাব উদ্দিন, মোহাম্মদ সিকদারসহ প্যারাবন দখল মামলার ২০ থেকে ২৫ জন আসামি প্রকাশ্যে হোয়ানক বাজারে ঘোরাফেরা করেন। কেউ কেউ কক্সবাজার শহরে অবস্থান নেন। তথ্যপ্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাঁদের গ্রেপ্তার করতে পারে—এ আতঙ্কে অনেকে মুঠোফোনও বন্ধ রাখেন। দখলদারেরা গ্রেপ্তার না হওয়ায় মহেশখালীর বিভিন্ন এলাকায় প্যারাবন নিধনের ঘটনা ঘটছে।

মহেশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ ইয়াছিন বলেন, সম্প্রতি কুতুবজুম ইউনিয়নের ঘটিভাঙা এলাকায় প্যারাবন দখল করে চিংড়িঘের নির্মাণ করা হয়েছিল। পরে সেটি দখলমুক্ত করা হলেও বিভিন্ন এলাকায় প্যারাবন দখল করে চিংড়িঘের নির্মাণের খবর পাচ্ছেন তিনি। কিন্তু বন বিভাগের পক্ষ থেকে তাঁকে জানানো হচ্ছে না।

গত ১৭ এপ্রিল ঝাপুয়া বন বিট কর্মকর্তা এইচ এম মাহমুদুল হাসান বাদী হয়ে মহেশখালী থানায় শাহাব উদ্দিনকে প্রধান আসামি করে এজাহারনামীয় ১০ জন ও অজ্ঞাতনামা আরও ২০ থেকে ৩০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলার এজাহারে বলা হয়, ৭২ একর প্যারাবনের ৭২ হাজার বাইনগাছ কেটে চিংড়িঘেরটি নির্মাণ করা হয়। বন বিভাগের ক্ষতি হয় ৫ কোটি ৬৫ লাখ ৪৪ হাজার ৪৮০ টাকা।

একই দিনে ১৪৪ একর প্যারাবন দখল করে চিংড়িঘের নির্মাণের ঘটনায় এরশাদ উল ইসলামসহ ৩৩ জনের বিরুদ্ধে পৃথক মামলা করেন ঝাপুয়া বিট কর্মকর্তা এইচ এম মাহমুদুল হাসান। ওই মামলায় অজ্ঞাতনামা আরও ৩০ থেকে ৪০ জন ব্যক্তিকে আসামি করা হয়। তাতে বন বিভাগের ক্ষতি দেখানো হয় ১১ কোটি ৩০ লাখ ৮৮ হাজার ৯৬০ টাকা।

পরদিন বিট কর্মকর্তা এইচ এম মাহমুদুল হাসান বাদী হয়ে মহেশখালী থানায় ৭২ একর প্যারাবন দখলের অভিযোগে মোহাম্মদ সিকদারকে প্রধান আসামি করে ১৭ জনের নামে আরেকটি মামলা করেন। ওই মামলায় অজ্ঞাতনামা আরও ২০ থেকে ৩০ জনকে আসামি করা হয়।

বন কর্মকর্তারা বলছেন, আসামিরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকায় দখলকৃত প্যারাবন উচ্ছেদ করতে পারছে না বন বিভাগ। দিনরাতে চিংড়িঘেরগুলোয় পাহারায় রাখা হয় অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের। বাইরের কেউ ঘটনাস্থলে গেলে গুলি ছোড়া হয়।

এ প্রসঙ্গে মহেশখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রণব চৌধুরী বলেন, প্যারাবন নিধন করে চিংড়িঘের নির্মাণের ঘটনায় বন বিভাগের করা চারটি মামলা তদন্তাধীন রয়েছে। তদন্তে প্যারাবন দখলের সত্যতা প্রমাণিত হলে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

তদন্ত শেষ করতে আর কত দিন লাগবে জানতে চাইলে ওসি বলেন, সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে। দ্রুত আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হবে।