ছেলেকে হারিয়ে দিশেহারা ফাতেমা বেগম। গতকাল মঙ্গলবার সকালে লক্ষ্মীপুর পৌরসভার রাজীবপুর এলাকায়
ছেলেকে হারিয়ে দিশেহারা ফাতেমা বেগম। গতকাল মঙ্গলবার সকালে লক্ষ্মীপুর পৌরসভার রাজীবপুর এলাকায়

গ্যারেজ মেকানিক ছেলের মৃত্যুতে মা নির্বাক, বোনদের আহাজারি

পঞ্চাশোর্ধ্ব ফাতেমা বেগম নির্বাক। অপলক তাকিয়ে আছেন। চোখে পানি নেই। পাশেই তাঁর দুই মেয়ে মুন্নি বেগম ও শিউলি বেগম বুক চাপড়ে বিলাপ করছেন। গতকাল মঙ্গলবার সকালে এই দৃশ্য দেখা যায় লক্ষ্মীপুরে বাসের সিলিন্ডার বিস্ফোরণে নিহত আরিফ হোসেন ওরফে হৃদয়ের (১৯) বাড়িতে গিয়ে।

হৃদয়ের বাড়ি লক্ষ্মীপুর পৌরসভার রাজীবপুর এলাকায়। তাঁর মা ফাতেমা নির্বাক হয়ে বসে ছিলেন ঘরের সামনে। একপর্যায়ে যেন সংবিৎ ফিরে পেলেন তিনি। চোখের পানি তাঁর গাল বেয়ে ঝরতে থাকে। স্বজনেরা এ সময় তাঁকে নানা কথা বলে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেন। এরপর ছেলের বিষয়ে নানা প্রসঙ্গ তুলে বিলাপ করতে থাকেন।

গত রোববার দিবাগত রাত দুইটার দিকে ঢাকা-লক্ষ্মীপুর আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশে গ্রিন লাইফ ফিলিং স্টেশনে গ্যাস রিফিলের সময় একটি বাসের গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়। এ সময় ঘটনাস্থলে ৩ জন নিহত হন, আহত হন আরও ১০ জন।
নিহত অপর দুজন মো. সুমন ও ইউসুফ হোসেন নামের দুই অটোরিকশাচালক। এ ঘটনায় ইউসুফ হোসেনের স্ত্রী নাসিমা বেগম বাদী হয়ে লক্ষ্মীপুর সদর থানায় মামলা করেছেন। এতে বাসমালিক সাইফুল ইসলামসহ দুজনকে আসামি করা হয়।

ফাতেমা বেগম বলেন, ‘হাত ভাঙ্গি গেছে। ২০০ টিয়ার ওষুধ লাগে হত্যেকদিন। হৃদয় ওষুধের টিয়া দেয়। অন হেই ওষুধ কে কিনব?’ (হাত ভেঙে গেছে। প্রতিদিন ২০০ টাকার ওষুধ লাগে। হৃদয় ওষুধের টাকা দিত। এখন কে ওষুধ এনে দেবে?)

সংসারের অভাবের কারণে হৃদয় অল্প বয়সেই কাজে যোগ দেন

ফাতেমা বেগম জানান, কিছুদিন আগে তাঁর হাত ভেঙে যায়। এর পর থেকে তাঁর যা ওষুধের প্রয়োজন হতো, সবই কিনে দিতেন হৃদয়। গত সোমবার দুপুরেও ওষুধ নিয়ে বাড়িতে আসার কথা ছিল তাঁর। তবে ছেলে ঘরে এসেছেন লাশ হয়ে।

ফাতেমা জানান, সংসারের অভাবের কারণে হৃদয় অল্প বয়সেই কাজে যোগ দেন। বাস, ট্রাকসহ বিভিন্ন যানবাহনের মেকানিক হিসেবে কাজ করতেন তিনি। যে ফিলিং স্টেশনটিতে বাসের সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ঘটেছে, এর পাশের একটি গ্যারেজে কর্মরত ছিলেন হৃদয়।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, হৃদয়ের বাবা মো. সিরাজ রিকশা-অটোরিকশার মেকানিক হিসেবে কাজ করেন। ছেলে উপার্জনক্ষম হওয়ায় সংসারের খরচ বহনে তাঁর ওপর চাপ কিছুটা কমেছিল। ছেলের মৃত্যুতে বাবা সিরাজসহ পরিবারের সব সদস্যই যেন দিশাহারা। এই দুর্ঘটনার জন্য দায়ীদের বিচার দাবি করেন হৃদয়ের ভাই ওমর ফারুক।

বিস্ফোরণের ঘটনা তদন্তে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট প্রিয়াংকা দত্তকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে জেলা প্রশাসন। পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে কমিটিকে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।

লক্ষ্মীপুর সদর মডেল থানার ওসি মো. আবদুল মোন্নাফ প্রথম আলোকে বলেন, প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে, ওই বাসের গ্যাস সিলিন্ডার নিম্নমানের এবং মেয়াদোত্তীর্ণ ছিল। বাসমালিকের অবহেলার কারণে দুর্ঘটনাটি ঘটেছে। তাঁকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
গতকাল লক্ষ্মীপুর সদর হাসপাতালে বিস্ফোরণে আহত হয়ে চিকিৎসাধীন সুমন হোসেনের (২৫) সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, তিনিও বাসের চালক। তাঁর বাসটি বিস্ফোরিত বাসের পরেই ছিল। বাস থেকে নেমে তিনি পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। হঠাৎ বিকট শব্দে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এরপর আর কিছু তাঁর মনে নেই। হাসপাতালে আনার পর দেখেন, শরীরের বিভিন্ন স্থানে জখম হয়েছে।

ফিলিং স্টেশনটির নিরাপত্তা প্রহরী মো. হুমায়ুন বলেন, ‘বাসটিতে গ্যাস রিফিল করার সময় সেটি কেঁপে ওঠে। বাসে কোনো যাত্রী ছিল না। যিনি গ্যাস রিফিল করছিলেন তিনি দ্রুত গ্যাসের নজেল খুলে নেন। সঙ্গে সঙ্গে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে।’

লক্ষ্মীপুর সদর আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তা অরূপ পাল বলেন, হাসপাতালে আহত ১০ জনকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে কয়েকজনের হাত-পা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। প্রাথমিক চিকিৎসার পর তাঁদের ঢাকায় নিয়ে যেতে বলা হয়।