হাসপাতালে ওয়ার্ড বয় ও আয়ার পাঁচটি পদের সব কটিই শূন্য। পাঁচটি পদের বিপরীতে পরিচ্ছন্নতাকর্মী মাত্র একজন।
খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স তীব্র জনবলসংকটে ভুগছে। চিকিৎসক, নার্স, কর্মচারী—এমনকি পরিচ্ছন্নতাকর্মীর অধিকাংশ পদ শূন্য থাকায় হাসপাতালটিতে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা যথাযথ সেবা পাচ্ছেন না। এদিকে ৫০ শয্যার এই হাসপাতাল চলছে ১৯ শয্যার একটি ভবনে। এতে সব রোগীকে গাদাগাদি করে থাকতে হচ্ছে। অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা বাইরে বেশি টাকায় করাতে হচ্ছে রোগীদের।
আধুনিক সব সরঞ্জামসহ রয়েছে সুসজ্জিত অস্ত্রোপচারকক্ষ। কিন্তু চিকিৎসক-সংকটের কারণে রোগীদের অস্ত্রোপচার করা যাচ্ছে না। জরুরি প্রয়োজনে রোগীদের বেশি টাকা খরচ করে জেলা শহরের বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিকে গিয়ে অস্ত্রোপচার করাতে হচ্ছে।
বটিয়াঘাটা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্র জানায়, ১৯৭৬ সালে উপজেলা সদরের হাটবাটি এলাকায় স্থাপিত এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ২০১৪ সালে ৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। তবে এখনো ৫০ শয্যার জনবলের প্রশাসনিক অনুমোদন পায়নি হাসপাতালটি। উপজেলার সাতটি ইউনিয়নের প্রায় দুই লাখ মানুষ এখান থেকে স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে থাকেন।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অস্ত্রোপচার বন্ধ থাকায় ভবন, চিকিৎসক ও জনবল-সংকটে হাসপাতালের সেবা কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। প্রসূতিদের অস্ত্রোপচারের জন্য একজন গাইনি সার্জন ও একজন অবেদনবিদ প্রয়োজন। হাসপাতালে স্ত্রীরোগবিশেষজ্ঞ থাকলেও কোনো অবেদনবিদ নেই। অন্যান্য অস্ত্রোপচারের জন্য হাসপাতালটিতে সার্জারি-বিশেষজ্ঞও নেই।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসক, নার্স, তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীসহ মোট পদ রয়েছে ১৭১টি। এর মধ্যে ৫১টি পদ শূন্য। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসকের পদ রয়েছে ১৭টি। এর বিপরীতে কর্মরত রয়েছেন ১০ জন। চিকিৎসা কর্মকর্তাদের আটটি পদের চারটি শূন্য। জুনিয়র কনসালট্যান্ট পদের চারটি পদের বিপরীতে কর্মরত আছেন গাইনি ও মেডিসিন-বিশেষজ্ঞ দুজন। এর মধ্যে মেডিসিন-বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সব সময় হাসপাতালে আসেন না। শূন্য রয়েছে সার্জারি, অ্যানেসথেসিয়া-বিশেষজ্ঞের পদ। হাসপাতালে একজন ডেন্টাল সার্জন ছিলেন। তিনি চলে গেছেন। ফলে এখানে দন্তরোগের সেবা পাওয়ার উপায় নেই। হাসপাতালে প্রতি মাসে প্রচুর শিশু রোগী চিকিৎসা নিতে এলেও এই হাসপাতালে শিশুবিশেষজ্ঞের কোনো পদ নেই।
অর্থোপেডিক, চক্ষু, চর্ম ও যৌন, শিশু, নাক কান গলা, হৃদ্রোগ-বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো আজও সৃষ্টি করা হয়নি। এ ছাড়া হাসপাতালে ওয়ার্ড বয় ও আয়ার পাঁচটি পদের সব কটিই শূন্য। পাঁচটি পদের বিপরীতে পরিচ্ছন্নতাকর্মী মাত্র একজন। আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নেওয়া কয়েকজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী পরিচ্ছন্নতার বিষয়টি দেখভাল করেন।
হাসপাতালটিতে ২০১৪ সালে অপারেশন থিয়েটার (ওটি) চালু হয়। তবে সেই থেকে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সব ধরনের অস্ত্রোপচারই বন্ধ ছিল। ২০২২ সালের মার্চে মাসে অস্ত্রোপচার চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়। বিশেষজ্ঞ অবেদনবিদ না থাকলেও অ্যানেসথেসিয়ায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসা কর্মকর্তা শামীম রহমান অবেদনবিদের দায়িত্ব পালন করতেন। তবে চলতি বছর মার্চে তাঁকে শহীদ শেখ আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতালে বদলি করা হয়। এতে আবার অস্ত্রোপচার কার্যক্রম থমকে দাঁড়ায়।
হাসপাতালে গত জানুয়ারি থেকে এপ্রিল—এই চার মাসে ২১ হাজার ৯৬৩ জন রোগী বহির্বিভাগে সেবা নিয়েছেন। এর মধ্যে ১২ হাজার ৮৮১ জন নারী এবং ১ হাজার ৯৪৯ জন শিশু রোগী; অর্থাৎ মাসে গড়ে এখানে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার রোগী বহির্বিভাগে সেবা নেন। গত এপ্রিল মাসে প্রতিদিন গড়ে ৬৩ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন।
৬ মে সরেজমিনে সকাল ১০টা থেকে বেলা দেড়টা পর্যন্ত এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ঘুরে এবং রোগীদের সঙ্গে কথা বলে বিভিন্ন সমস্যার কথা জানা যায়। হাসপাতালটিতে একটি পুরোনো দ্বিতল ভবন ও একটি নতুন তিনতলা ভবন আছে। পুরোনো দ্বিতল ভবনটিতে কোনো রোগী রাখার ব্যবস্থা নেই। ভবনটি কিছুটা সংস্কার করে প্রশাসনিক ভবন হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। সেখানে উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তার কার্যালয়, ফার্মেসি ও সম্মেলনকক্ষ করা হয়েছে। চিকিৎসা নেওয়ার জন্য উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তার কক্ষের সামনে রোগীর দীর্ঘ সারি দেখা গেছে। ১৯ শয্যার নতুন ভবনে সব রোগী রাখা হচ্ছে। বিভিন্ন ওয়ার্ডের বাইরে বারান্দাতেও শয্যা পাতা হয়েছে। নতুন ভবনে দোতলায় হাসপাতালের অস্ত্রোপচারের কক্ষটি তালাবদ্ধ। ওটি ইনচার্জ সিনিয়র স্টাফ নার্স সুনেত্রা বিশ্বাসের সহযোগিতায় তালা খোলা হয়। দেখা যায়, সেখানে অস্ত্রোপচারের জন্য সব সরঞ্জাম রয়েছে। পাশে পোস্ট অপারেটিভ কক্ষটিও সুসজ্জিত। তবে হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের কোনো ব্যবস্থা নেই।
বটিয়াঘাটার গঙ্গারামপুর ইউনিয়নের সুখদাঁড়া গ্রামের বাসিন্দা নিতু মণ্ডল বুকে-পিঠে ব্যথা নিয়ে আট দিন ধরে হাসপাতালের মহিলা ওয়ার্ডে ভর্তি আছেন। তিনি বলেন, প্রতিদিন চিকিৎসক দেখে যান। খাওয়াদাওয়াও ভালো। শুধু কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা বাইরে থেকে করতে হয়েছে।
এসব ব্যাপারে জানতে চাইলে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘অস্ত্রোপচারকক্ষ চালু করতে পারলে মানুষ উপকৃত হতো। অবেদনবিদ না থাকার পরও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসক দিয়ে অস্ত্রোপচারকক্ষ চালু করেছিলাম। সেই চিকিৎসককে মার্চে বদলি করা হয়েছে। গুরুত্বের বিবেচনায় তাঁকে এখান থেকে না নেওয়ার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছিলাম, কোনো সুরাহা হয়নি। জনবলসংকটের বিষয়টি প্রতি মাসের প্রতিবেদনেই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হচ্ছে।’