নওগাঁর পোরশা উপজেলায় তৌফিক শাহ চৌধুরী নামের এক বিএনপি নেতার বিরুদ্ধে সংখ্যালঘুসহ ১৩ জন কৃষকের ৫৬ বিঘা জমি দখলের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসব জমিতে আমন ধানের চারা রোপণ করা হয়েছিল। জমিতে নিড়ানি দেওয়া, সার দেওয়াসহ কোনো কাজ করতে পারছেন না ভুক্তভোগী কৃষকেরা। তাঁরা জমিতে গেলে প্রাণে মেরে ফেলা হবে বলে হুমকি দিয়েছেন ওই নেতা।
এ পরিস্থিতিতে প্রতিকার পেতে ওই ১৩ জন কৃষক প্রত্যেকে পৃথকভাবে তৌফিক শাহ চৌধুরীর বিরুদ্ধে থানায় লিখিত অভিযোগ করেছেন। তৌফিক শাহ চৌধুরী পোরশা উপজেলা বিএনপির সাবেক সহসভাপতি। তিনি উপজেলা বিএনপির সভাপতি পদপ্রার্থী ছিলেন। তবে থানা–পুলিশ একটি অভিযোগও এজাহার হিসেবে গ্রহণ করেননি। তারা ওই কৃষকদের আদালতের শরণাপন্ন হতে বলছে।
ভুক্তভোগী কৃষকদের দাবি, গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে বিএনপি নেতা তৌফিক শাহ লোকজন নিয়ে জোর করে তাঁদের জমি দখল করে নিয়েছেন। অথচ তাঁরা কেউ দলীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নন।
আর বিএনপি নেতা তৌফিক শাহর দাবি, জমিগুলো তাঁর। বরং ১৫ বছর আগে ক্ষমতার জোরে তাঁরাই (অভিযোগকারী কৃষকেরা) দখলকরে নিয়েছিলেন। তারপরও তিনি জমিগুলো পুনর্দখল করেননি। এখন জমি দখলের যে অভিযোগ করা হচ্ছে, তার কোনো ভিত্তি নেই। কৃষকদের জমিতে যেতে বাধা কিংবা তাঁদের কোনো ধরনের ভয়ভীতি তিনি দেখাননি।
১৩ কৃষকের দেওয়া লিখিত অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, উপজেলার পোরশা মিনাবাজার এলাকার বাসিন্দা সাব্বির হামজা চৌধুরী নামের এক ব্যক্তির কাছ থেকে জমি বর্গা নিয়ে উপজেলার তেঁতুলিয়া মৌজায় তেঁতুলিয়া মঠবাড়ি গ্রামের কৃষক দুর্জয় মণ্ডল, কাঠপুকুর গ্রামের রবি ওঁরাও, সিরাজপুর গ্রামের মো. বাবুল, গোপালপুর গ্রামের মোকলেসুর রহমান, মাহতাব কাজী, সলেমান ও খায়রুল ইসলাম চাষাবাদ করে আসছেন। এ ছাড়া উপজেলার সিরাজপুর মৌজায় সিরাজপুর গ্রামের ফতের আলী সরদার, একই গ্রামের বেলাল সরদার, মো. মাসুদ ও মতিউর রহমান এবং মোহরপাড়া গ্রামের আসাদুল ইসলাম ও বেলাল হোসেন ওই একই ব্যক্তির কাছ থেকে জমি লিজ নিয়ে চাষাবাদ করে আসছেন। ওই ১৩ কৃষকের বর্গা নেওয়া জমির মোট পরিমাণ ৫৬ বিঘা। চলতি আমন মৌসুমে তাঁরা সেই জমিতে ধান আবাদ করেছেন। কিন্তু ৫ আগস্টের পর বিএনপি নেতা তৌফিক শাহ ও তাঁর অনুসারীরা দলবদ্ধ হয়ে ওই ১৩ কৃষকের জমি দখল করে নেন। এর পর থেকে ওই কৃষকেরা জমিতে যেতে পারছেন না। এমনকি জমির কাছে গেলে তাঁদের প্রাণে মেরে ফেলা হবে বলেও হুমকি দেওয়া হচ্ছে।
কৃষক মাহতাব কাজী, খাইরুল ইসলাম ও মোকলেছুর রহমান ১২ আগস্ট; দুর্জয় মণ্ডল ১৫ আগস্ট এবং রবি ওঁরাও ও সলেমান ১৭ আগস্ট থানায় অভিযোগ করেন। এসব অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, ৭ আগস্ট থেকে ১৩ আগস্টের মধ্যে ওই ছয় কৃষকের ২৪ বিঘা জমি দখল করে নেওয়া হয়েছে। সব কটি অভিযোগেই বিএনপি নেতা তৌফিক শাহকে প্রধান আসামি করে স্থানীয় শামসুল হক, আলাউদ্দিন, আব্দুল আলীম, জামাল মোল্লাসহ ১০ থেকে ১৫ জনের নাম উল্লেখ এবং অজ্ঞাত আরও ১৫ থেকে ২০ জনকে আসামি করার আবেদন করা হয়েছে।
এ ছাড়া কৃষক ফতের আলী সরদার, মো. বাবুল, মতিউর রহমান, মো. মাসুদ, বেলাল সরদার, আসাদুল ইসলাম ও বেলাল হোসেন ১৮ আগস্ট থানায় পৃথক অভিযোগ করেন। এসব অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, ৬ আগস্ট তৌফিক শাহর নির্দেশে বোরাম গ্রামের আফজাল হোসেন, আবদুল খালেক, আনিসার রহমান, মেসের আলী ও অজ্ঞাতনামা ২০ থেকে ২৫ জন তাঁদের জমি দখল করে নেন।
তেঁতুলিয়া মঠবাড়ি গ্রামের কৃষক দুর্জয় মণ্ডল বলেন, ‘পোরশার মিনাবাজার এলাকার বাসিন্দা সাব্বির হামজা চৌধুরীর কাছ থেকে তেঁতুলিয়া মৌজার বাঁশকুড়ি মাঠে ১০ বিঘা জমি বর্গা নিয়ে ৫ বছর ধরে চাষাবাদ করছি। চলতি মৌসুমে ওই ১০ বিঘা জমিতে আমন ধান রোপণ করেছি। গত ১৩ আগস্ট সকাল থেকে আমার কয়েকজন শ্রমিক ধানখেতে নিড়ানি দিচ্ছিল। সকাল ৯টার দিকে পোরশার তৌফিক শাহ ৩৫ থেকে ৪০ জন লোক নিয়ে জমিতে এসে শ্রমিকদের সেখান থেকে সরিয়ে দেন। খবর পেয়ে আমি সেখানে গেলে তাঁরা আমাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ধাওয়া করেন। দৌড়ে পালিয়ে আমি জীবন রক্ষা করি। এখন তৌফিক শাহ ও তাঁর লোকজন বিভিন্নভাবে আমাকে হুমকি দিচ্ছেন। ওই জমিতে দ্বিতীয়বার গেলে প্রাণে মেরে ফেলা হবে বলে হুমকি দিচ্ছেন।’
ক্ষুদ্র জাতিসত্তার কৃষক রবি ওঁরাও বলেন, ‘গরিব মানুষ হামি। নিজের জমি বলতে খালি একটা বাড়ি আছে। মানুষের জমিত কামলা দিয়ে আর তিন বিঘা জমি বর্গা নিয়ে চাষাবাদ করে সংসার ভালোই চলোছিল। কিন্তুক একদিন ৩০ থেকে ৪০ জন লোক বাড়িত অ্যাসে বলে গেছে, এই জমি নাকি তৌফিক শাহর। ওই জমিত য্যাতে নিষেধ করে গেছে। জমিত গেলে ঠ্যাঙ কাটে দেবে বলে হুমকি দিছে গেছে ওরা।’
সিরাজপুর গ্রামের কৃষক ফতের আলী সরদার বলেন, ‘উপজেলার সিরাজপুর-বোরাম মাঠে বর্গা নেওয়া ৬ বিঘা জমিতে ধান আবাদে এখন পর্যন্ত প্রায় ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা খরচ করেছি। এখন আবাদ করা ধান কেটে ঘরে না তুলতে পারলে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে আমাকে পথে বসতে হবে। থানায় অভিযোগ করা হলেও এখন পর্যন্ত পুলিশ জমির ধান কেটে ঘরে তুলতে পারব কি না, সে ব্যাপারে কোনো আশ্বাস দিতে পারছে না।’
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হয় হয় জমি বর্গা দেওয়া সাব্বির হামজা চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমার দাদার দাদা ইব্রাহিম শাহ মোট ১ হাজার ১০০ বিঘা জমি ওয়াক্ফ আলাল আওলাদ করে দেন। ওয়াক্ফ প্রশাসকের আদেশে ২০১৬ সাল থেকে ওই সব ওয়াক্ফ সম্পত্তির অফিশিয়াল মোতাওয়াল্লি (রক্ষণাবেক্ষণকারী) হিসেবে আমি নিয়োগ পাই। কিন্তু এত দিন তৌফিক শাহ চৌধুরী ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের কিছু নেতা অবৈধভাবে ওই সব ওয়াক্ফ সম্পত্তি দখল করে ছিলেন। নিয়ম হচ্ছে, মোতাওয়াল্লির মাধ্যমে ওয়াক্ফ সম্পত্তি ভোগদখল করতে হবে। অফিশিয়াল মোতাওয়াল্লি হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর থেকে জমির দখল বুঝে নিতে গেলে তৌফিক শাহর নির্দেশে আমাদের ওপর একাধিকবার হামলার ঘটনা ঘটেছে। ২০১৭ সালে হামলায় একজন কৃষকের মৃত্যুও হয়। এসব ঘটনায় একাধিক মামলা চলমান।’
সাব্বির হামজা চৌধুরী আরও বলেন, ‘বৈধ মোতাওয়াল্লি হওয়ার পরও আমি এখনো ওয়াক্ফ করা সব সম্পত্তি বুঝে পাইনি। তৌফিক শাহ এখনো অবৈধভাবে জমি দখল করে আছেন। আংশিক যেটুকু জমি আমার দখলে ছিল, ৫ আগস্টের পর উদ্ভূত পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে সেই জমিগুলোও দখল করে নেওয়া হচ্ছে। অভিযোগকারী ১৩ কৃষক ছাড়াও আরও ৫০ থেকে ৬০ জন বর্গাচাষিকে তৌফিক শাহ জমিতে না যাওয়ার জন্য হুমকি দিয়েছেন। কিন্তু ওই কৃষকেরা ভয়ে থানায় অভিযোগ করছেন না।’
১৩ বর্গাচাষির অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তৌফিক শাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওই জমিগুলোর প্রকৃত মালিক আমি। আমার কাগজপত্র সব আছে। ১৫ বছর আগে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে সাবেক খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের ছত্রচ্ছায়ায় আওয়ামী লীগের লোকজন আমার বেশ কিছু জমি দখল করে নেয়। একের পর এক মামলা দিয়ে এত দিন অন্যায়ভাবে তারা আমার জমি দখল করে আসছিল। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ওই দখলকারীরা সবাই আত্মগোপনে চলে গেছেন। আমি কোনো জমি দখল করতে যাইনি। এ ছাড়া দলীয়ভাবে আমাকে হেয় করার জন্য আমার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ মোজ্জাম্মেল শাহ চৌধুরীর ইন্ধনে ওই ছয় কৃষক আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করেছেন।’
তৌফিক শাহর করা অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে পোরশা উপজেলা বিএনপির সভাপতি মোজাম্মেল শাহ চৌধুরী বলেন, ‘তৌফিক শাহর অপকর্মের কথা এ উপজেলার অধিকাংশ মানুষই জানেন। এখানে আমাকে দোষ দিয়ে তিনি তাঁর অপকর্ম ঢাকতে পারবেন না। শুধু ওই ১৩ কৃষকই নন, আরও অনেক কৃষক তাঁর দখলদারির শিকার হয়ে নিঃস্ব হয়েছেন।’ মোজাম্মেল শাহ চৌধুরী আরও বলেন, দলীয় পরিচয়ে যাঁরা দখলবাজি করে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করবেন, তাঁদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে দলের হাইকমান্ড। ইতিমধ্যে তাঁর (তৌফিক শাহ) বিরুদ্ধে বিভিন্ন পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ হওয়ায় তাঁর বিরুদ্ধে দলের পক্ষ থেকে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছে। বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সহসাংগঠনিক সম্পাদক এ এইচ এম ওবায়দুর রহমান গত ৪ সেপ্টেম্বর পোরশা থানায় এই জিডি করেন। জিডিতে তৌফিক শাহর বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। তৌফিক শাহ বর্তমানে ‘দলীয় পদে না থাকায়’ সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
জানতে চাইলে পোরশা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আতিয়ার রহমান বলেন, ‘গত ৫ আগস্টের পর জমি দখলসংক্রান্ত বিভিন্ন অভিযোগ পেয়েছি। আমাদের জমিসংক্রান্ত বিষয়ে কিছু করণীয় নেই। এ ছাড়া জমি দখল করে দেওয়া পুলিশের কাজ নয়। তাই আমরা ভুক্তভোগীদের ডেকে সুন্দরভাবে বুঝিয়ে আদালতের শরণাপন্ন হতে বলছি। আর যেগুলো সমাধান করা যাচ্ছে, সেগুলো সমাধান করে দিচ্ছি।’