শিলাবৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্ত পানগাছ। সোমবার মৌলবাজারের লাউয়াছড়াপুঞ্জির পানজুমে
শিলাবৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্ত পানগাছ। সোমবার মৌলবাজারের লাউয়াছড়াপুঞ্জির পানজুমে

মৌলভীবাজারের খাসিয়াপল্লি

শিলায় ক্ষতিগ্রস্ত পান উৎপাদন

শিলার আঘাতে পানগাছের লতা ভেঙে পড়েছে। শিলার আঘাতে পানে যে ক্ষত বা দাগ সৃষ্টি হয়েছে, তাতে পাতা পচা রোগের সৃষ্টি হচ্ছে।

পানপুঞ্জির (আদিবাসী গ্রাম) পানজুমগুলোতে (পানের খেত/বরজ) গাছে গাছে নতুন পান এসেছে। নতুন-পোক্ত পান তোলা শুরুও হয়ে গেছে। পান তোলা নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটছে খাসিয়া পানপুঞ্জিগুলোর চাষিদের। কিন্তু নতুন পান তোলার শুরুর এই সময়ে দফায় দফায় শিলাবৃষ্টিতে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছেন তাঁরা। মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া, মাগুরছড়াসহ বিভিন্ন পানপুঞ্জিতে শিলাবৃষ্টির তাণ্ডব ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠছে।

শিলাবৃষ্টির কারণে একদিকে যেমন পান ঝরে পড়েছে, পানগাছের লতা ভেঙে পড়েছে, অন্যদিকে শিলার আঘাতে পানে যে ক্ষত বা দাগ সৃষ্টি হয়েছে, তাতে পাতা পচা রোগের সৃষ্টি হচ্ছে। পানের জন্য এই পাতা পচা রোগ অনেক সংক্রামক ও ক্ষতিকর। এতে খাসিয়া পানের উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

খাসি সোশ্যাল কাউন্সিলের প্রচার সম্পাদক ও লাউয়াছড়াপুঞ্জির বাসিন্দা সাজু মারছিয়াং গতকাল মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, শীতকালে খরা থেকে পানগাছ বাঁচাতে পানের বরজে সেচের ব্যবস্থা করেছেন অনেক পানচাষি। পান গাছে নিয়মিত পানি দেওয়ার জন্য তাঁরা ঋণ করে গভীর নলকূপের ব্যবস্থা করেছেন, যাতে পান গাছে আগাম ফসল (পান) আসে। পানের ভালো দাম পাওয়ার আশা নিয়ে গাছের যত্ন করেছেন তাঁরা। কিন্তু শিলাবৃষ্টি তাঁদের সবকিছু নষ্ট করে দিল।

খাসি সোশ্যাল কাউন্সিল, পানপুঞ্জির মান্ত্রী (পুঞ্জিপ্রধান) ও পানচাষি সূত্রে জানা গেছে, এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে কয়েক দফায় কালবৈশাখী ও শিলাবৃষ্টি হয়েছে। এতে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জ উপজেলার লাউয়াছড়াপুঞ্জি, বালিশিরাপুঞ্জি, মাগুরছড়াপুঞ্জি, দেবলছড়া, গবিনছড়া, কাটাবিল, কুরমা, কালেঞ্জিপুঞ্জিসহ বিভিন্ন এলাকার পানপুঞ্জির পানজুমে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। শিলাবৃষ্টির আঘাতে অনেক পানগাছে পানের পাতায় ছিদ্র হয়ে গেছে। পাতা ছিঁড়ে গেছে। পানগাছের লতা ভেঙে গেছে। পাতা ছিঁড়ে যাওয়ায় এই পান আর বিক্রি করা যাবে না।

পান চাষের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা জানান, সাধারণত এপ্রিল মাস থেকে ‘লবর (নতুন পাতা তোলার মৌসুম)’ শুরু হয়ে থাকে। এই সময়ে পানগাছে নতুন পাতা আসে। নতুন পাতা তোলা শুরুও হয়েছে। কিন্তু খাসিয়া পান তোলার মৌসুমে শিলাবৃষ্টির আঘাতে ক্ষতির মুখে পড়েছেন বিভিন্ন পুঞ্জির পানচাষিরা। চাষিরা জানিয়েছেন, শিলাবৃষ্টির আঘাতে পানের পাতা ছিদ্র, পান গাছের লতা ভেঙে যাওয়া, ডাল থেঁতলে যাওয়ায় অনেক গাছ দুর্বল হয়ে পড়েছে। যে কারণে এক সময় পান গাছ মারা যাবে।

শিলাবৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্ত গাছ থেকে ভবিষ্যতে পান উৎপন্ন না হওয়ার আশঙ্কা আছে। ক্ষত হওয়া পান লাল হয়ে ‘উত্রাম (পাতা পচা রোগ)’ রোগের প্রাদুর্ভাব হতে পারে। পানের জুমের জন্য উত্রাম অনেক ক্ষতিকর একটি রোগ। এটি দ্রুত পাতা থেকে পাতায় ছড়িয়ে পড়ে। পানগাছের ওপরের দিকে এই রোগের প্রাদুর্ভাব হলে ওপরের দিকে গাছ কেটে ফেলতে হয়। গোড়ার দিক থেকে পচা শুরু হলে গাছটাই কেটে ফেলতে হয়।

খাসিপুঞ্জির লোকজনের জীবিকার প্রধান উৎসই হচ্ছে খাসি পানের চাষ। খাসি সোশ্যাল কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক ও লাউয়াছড়া খাসিয়াপুঞ্জির মান্ত্রী ফিলা পতমী গত সোমবার বলেন, লাউয়াছড়া খাসিয়াপুঞ্জিতে ৩০টি পরিবার বসবাস করছে। শিলাবৃষ্টির কারণে এই পুঞ্জিতেই ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকার পানের ক্ষতি হয়েছে।

কমলগঞ্জের মাগুরছড়াপুঞ্জি সূত্রে জানা গেছে, মাগুরছড়াপুঞ্জির প্রায় অর্ধেক জুমের পান শিলাবৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শিলাবৃষ্টিতে এই পুঞ্জির (মাগুরছড়ার) পশ্চিম দিকে বেশি ক্ষতি হয়েছে। পূর্ব দিকে শিলাবৃষ্টি কম হওয়ায় ওই দিকে এতটা ক্ষতি হয়নি।

শিলাবৃষ্টির ফলে পানচাষিদের অনেক ক্ষতি হয়েছে জানিয়ে খাসি সোশ্যাল কাউন্সিলের সভাপতি ও মাগুরছড়াপুঞ্জির মান্ত্রী জিডিশন প্রধান সুছিয়াং প্রথম আলোকে বলেন, শিলাবৃষ্টি ডিগা (কচি) পান ফুটা (ছিদ্র) করে ফেলছে। পান ছিঁড়ে গেলে বা নিচে পড়ে গেলে অতটা ক্ষতি নেই। বড় আশঙ্কা হচ্ছে, ফোটা বা দাগ থেকে উত্রাম সৃষ্টি হলে বেশি ক্ষতি হয়। এই রোগটা খুব তাড়াতাড়ি ছড়ায়।