গাজীপুরের মুক্ত জলাশয়ের সুস্বাদু মাছে একসময় রাজধানী ঢাকার আমিষের চাহিদা মিটত অনেকখানি। নদী-বিলে মাছ ধরে সংসার চালাতেন প্রান্তিক জেলেরা। কিন্তু শিল্পকারখানার বর্জ্যে মুক্ত জলাশয়ের মাছের পরিমাণ দিন দিন কমছে। কারখানার আশপাশের জমিতে কমছে ফসলের উৎপাদন।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকার শত শত শিল্পকারখানার তরল বিষাক্ত বর্জ্য পরিশোধন ছাড়াই বাইরে ফেলা হচ্ছে। সেই দূষিত পানি ও বর্জ্য গিয়ে পড়ছে তুরাগ নদ ও খাল-বিলে। এ কারণে আশপাশের জলাশয় ও ফসলি জমি নষ্ট হচ্ছে। প্রতিকার চেয়ে এলাকাবাসী বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ দিলেও কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি পরিবেশ অধিদপ্তরকে।
এদিকে খোদ পরিবেশ অধিদপ্তর বলছে, জেলায় দুই হাজারের অধিক পোশাক কারখানার মধ্যে কেবল ৬০০ ডাইং কারখানায় ইটিপি বা বর্জ্য শোধনাগার রয়েছে। সেগুলোরও সব কটি কার্যকর নয়। পরিবেশদূষণের অভিযোগে বিভিন্ন কারখানায় অভিযান চালিয়ে জরিমানা, গ্যাস-বিদ্যুতের সংযোগ বিচ্ছিন্নের মতো ব্যবস্থা নেওয়া হলেও কিছুদিন পর আবার চালু হচ্ছে সেই কারখানাগুলো।
মহানগরীর কোনাবাড়ী, বাইমাইল, কড্ডা ও বাঘিয়া, কালিয়াকৈর উপজেলার বিভিন্ন এলাকার মানুষ তুরাগ নদ ও আশপাশের বিল থেকে মাছ ধরে পরিবারের খাওয়ার চাহিদা মেটাতেন। কিন্তু কারখানার তরল বর্জ্যের কারণে এখন মাছ মরে যাচ্ছে। যেটুকু মাছ পাওয়া যায়, সেগুলোও খাওয়ার অনুপযোগী। রান্না করলে রাসায়নিকের গন্ধ পাওয়া পায়।
বাঘিয়া এলাকায় তুরাগ নদের তীরে শতাধিক মাঝি পরিবার বংশপরম্পরায় মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে। গ্রামের বাসিন্দা জরুনাল রাজবংশী পাশের বিলে নৌকা নিয়ে জাল ফেলছেন। কিন্তু গত ১০ দিনে কোনো মাছের দেখা পাননি বলে জানালেন তিনি। দূষণে বিলের মাছ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে উল্লেখ করে জরুনাল রাজবংশী বলেন, ‘আগের মতো মাছ এখন আর পাওয়া যায় না। হাতে কাজকাম নেই, তাই জাল ফেলে বসে আছি যদি কিছু পাওয়া যায়।’
গাজীপুর মৎস্য অফিসের সহকারী পরিচালক জান্নাতুল শাহীন জানান, জেলায় ১ হাজার ৭২০ হেক্টর বিল রয়েছে। এ ছাড়া তুরাগ, বংশাইসহ ১০টি নদ–নদীর ১ হাজার ৭৫৩ হেক্টর জলাশয়ে প্রতিবছর ২ হাজার ৩২৩ মেট্রিক টন দেশি মাছ উৎপাদন হওয়ার কথা। কিন্তু গত ১৪ বছরে মাছের উৎপাদন কেবলই কমছে। এর জন্য প্রধানতম দায়ী কলকারখানার বিষাক্ত বর্জ্য। সুস্বাদু দেশি মাছের উৎপাদন ফিরিয়ে আনতে হলে প্রশাসনের সব বিভাগের সমন্বয় জরুরি বলে জানান এই মৎস্য কর্মকর্তা।
জেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা গেছে, ১৪ বছর আগে গাজীপুরের মুক্ত জলাশয়ে মাছের উৎপাদন হতো ২০ হাজার ৩৬১ মেট্রিক টন। বর্তমানে মুক্ত জলাশয়ে এই মাছের উৎপাদন কমে ১ হাজার ৯৫৩ মেট্রিক টনে দাঁড়িয়েছে।
নগরের কোনাবাড়ী এলাকায় বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনে (বিসিক) ডাইং ও ওয়াশিং কারখানা রয়েছে ১০টি। সরেজমিন দেখা গেছে, কারখানার প্রধান ফটকের সামনের নালা দিয়ে কুচকুচে কালো পানি ফেলা হচ্ছে। নাক না ধরে পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া যায় না। এই তরল চলে যাচ্ছে বাইমাইল তুরাগ নদের পাড় ও আশপাশের বিলে। ওই নালা দিয়ে শুধু বিসিকের লাইন নয়, আশপাশের কারখানাগুলোর তরল বর্জ্যের লাইনও সংযুক্ত করা হয়েছে। কড্ডা, বাইমাইল, সদর উপজেলার মনিপুর, টঙ্গীর বিসিকসহ বিভিন্ন এলাকার শিল্পকারখানাতেও একই দৃশ্য দেখা গেছে।
কোনাবাড়ী বিসিক শিল্পনগরীর কর্মকর্তা মো. শাহজাহান আলী বলেন, বিসিকের ভেতরে থাকা সব কারখানা ইটিপি ব্যবহার করছে। সেগুলো নিয়মিত মনিটরিংও করা হয়। আশপাশের অন্য কারখানার বর্জ্য বিলে বা নদে ফেলা হচ্ছে বলে তাঁর ধারণা।
কলকারখানার বর্জ্যে ফসলি জমির উৎপাদনও কমছে বলে জানিয়েছেন কৃষকেরা। এ ছাড়া শিল্পায়নের কারণে গত ১৫ বছরে জেলার ৬ হাজার হেক্টর ফসলি জমি কমেছে বলে জানিয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর।
কালিয়াকৈরের ঐতিহ্যবাহী মকশ বিলের কোলঘেঁষা গ্রাম তালতলী। সেখানকার বাসিন্দা ৭০ বছর বয়সী অতুল সন্ন্যাসী। একসময় নিজের পাঁচ-ছয় বিঘা জমিতে ফসল চাষ করে সারা বছর খেতেন তিনি। এখন আর সেসব জমি চাষের উপযোগী নেই। অতুল সন্ন্যাসী প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাড়ির আশপাশের প্রায় সব জমি আমার। আগে পাঁচ-ছয় বিঘা জমিতে সবজি, ধানসহ বিভিন্ন ফসলের চাষাবাদ করতাম কিন্তু এখন আর করতে পারি না। মিলের পচা পানির কারণে কিছু লাগালেও এখন হয় না। বহু আন্দোলন করেছি কিন্তু কোনো কাজ হয়নি।’
গাজীপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে জেলায় কৃষিজমির পরিমাণ ছিল ১ লাখ ১০ হাজার ২১৫ হেক্টর। বর্তমানে কৃষিজমি আছে ১ লাখ ৪ হাজার ১৭০ হেক্টর। অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা শিল্পকারখানা দূষণের কারণে ফসলি জমি কমে যাচ্ছে।
গাজীপুর পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক নয়ন মিয়া বলে, জেলার দুই হাজারের অধিক পোশাক কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে ৬০০ ডাইং কারখানায় ইটিপি রয়েছে। কিন্তু খাল-বিল ও নদীর দিকে তাকালেই দেখা যায়, এসব ইটিপি নিয়ম মেনে চালানো হয় না। পোশাক কারখানা বহাল রেখে নদী ও বিলে বিশুদ্ধ পানি মিলবে না। অভিযোগ পেলেই অভিযান চালানোর চেষ্টা করেন বলে দাবি এই কর্মকর্তার।
বাংলাদেশ নদী পরিব্রাজক দলের কেন্দ্রীয় সভাপতি মো. মনির হোসেন বলেন, গত কয়েক বছরে তুরাগ নদের তীরের বিভিন্ন জায়গা অবৈধ দখলমুক্ত করা হলেও দূষণের মাত্রা কমেনি। একটা সময় শিল্প স্থাপন করাটাই গুরুত্ব পেয়েছিল বেশি, কিন্তু পরিবেশের দিকটি বিবেচনা করা হয়নি। এখন সময় এসেছে নদী, খাল-বিল ও জলাশয়ের পরিবেশ রক্ষায় কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের।