রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরের ভেতরে বন্দিজীবন কয়েক হাজার বাংলাদেশির, আতঙ্কে নারী-শিশুরা

কক্সবাজারের উখিয়ার লম্বাশিয়া রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরের ভেতরে বাংলাদেশিদের ঘরবাড়ি। সম্প্রতি তোলা
ছবি: প্রথম আলো

কক্সবাজার শহর থেকে ৭০ কিলোমিটার দূরে টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়নের উনচিপ্রাং পুটিবনিয়া চাকমাপল্লি। পল্লিতে বসবাস ২৮টি চাকমা পরিবারের প্রায় ১৪০ জনের। একসময় তাঁরা পাহাড় ও সমতলের ৭৮ হেক্টর জমিতে জুমচাষ করে সংসার চালাতেন।

২০১৭ সালে ২৫ আগস্টের পর রোহিঙ্গাঢল শুরু হলে চাকমাপল্লিসহ আশপাশের ৭০০ একরের পাহাড়-জঙ্গলে প্রায় ২২ হাজার রোহিঙ্গার জন্য গড়ে তোলা হয় উনচিপ্রাং আশ্রয়শিবির, যার ভেতরে রয়েছে চাকমাদের ২৮টি পরিবার। আশ্রয়শিবিরটি চারদিকে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘিরে ফেলায় চাকমারা স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারেন না।

উনচিপ্রাং আশ্রয়শিবিরের মতো উখিয়ার কুতুপালং, লম্বাশিয়া, মধুরছড়া, বালুখালী, থাইংখালী, জুমশিয়া, টেকনাফের জাদিমুরা, শালবন আশ্রয়শিবিরে কাঁটাতারের বেড়ার ভেতরে বন্দিজীবন কাটাচ্ছেন কয়েক হাজার বাংলাদেশি। স্থানীয় মানুষের হিসাবে, আশ্রয়শিবিরগুলোর অভ্যন্তরে অন্তত ১ হাজার ৪০০ পরিবারের ৯ হাজার বাংলাদেশি বসবাস করেন। ছয় বছর ধরে কাঁটাতারের ভেতরে আটকে থাকায় তাঁরা স্বাধীন জীবনযাপন ও ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারছেন না। অর্থসংকটে পড়ে বহু পরিবারের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া বন্ধের উপক্রম হওয়ার পাশাপাশি ছেলেমেয়েদের বিয়েশাদিও বন্ধ আছে।

এসব বাসিন্দা বলছেন, আশ্রয়শিবিরগুলোয় প্রায় প্রতিদিন মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠীসহ একাধিক রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী বাহিনীর মধ্যে গোলাগুলি, সংঘর্ষ, হামলা, হত্যা ও অপহরণের ঘটনা ঘটছে। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে রোহিঙ্গাবসতিতে ‘পরিকল্পিতভাবে আগুন’ লাগানো ঘটনাও ঘটছে। তাতে বাংলাদেশি নারী ও শিশুদের আতঙ্কে থাকতে হয়।

এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশিদের আশপাশ থেকে রোহিঙ্গাবসতি উচ্ছেদ অথবা বাংলাদেশিদের অন্যত্র সরানোর দাবিতে আন্দোলন হলেও কোনোটির সুরাহা হচ্ছে না; বরং সংকট দিন দিন তীব্র হচ্ছে। জেলা প্রশাসন বলছে, অনুসন্ধান কমিটির মাধ্যমে সমস্যা চিহ্নিত করে সমাধান করা হবে।

বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখ। এর মধ্যে ৮ লাখ এসেছে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পরের কয়েক মাসে। দীর্ঘ ছয় বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি।

সম্প্রতি উনচিপ্রাং পুটিবনিয়া চাকমাপল্লি ঘুরে জানা গেল, খাদ্য, পানি, পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা, নিরাপত্তাসংকটে ভুগছেন চাকমারা। সেখানকার বাসিন্দা উকিলা চাকমা (৫৮) বলেন, চাকমাপল্লির চারপাশে রোহিঙ্গাবসতি। রোহিঙ্গারা তাঁদের ভিন্নদৃষ্টিতে দেখে। এখানে এক মিনিটের নিরাপত্তা নেই। অন্য কোথাও মাথা গোঁজার ঠাঁই থাকলে বহু আগে চলে যেতেন।

কক্সবাজারের টেকনাফের উনচিপ্রাং রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরের ভেতরে চাকমাদের ঘরবাড়ি। চারদিকে রয়েছে কাঁটাতারের বেড়া। সম্প্রতি তোলা

চাকমারা বলছেন, মিয়ানমারের উগ্র মগ সম্প্রদায়ের লোকজনের হাতে বিতাড়িত হয়ে বাংলাদেশে আসে রোহিঙ্গারা। নানা কারণে তারা চাকমাদের সহ্য করতে পারে না। কারণ, চাকমাদের চেহারা মগদের মতোই। মং চিচা চাকমা (৮১) বলেন, ছয় ধরে দুর্বিষহ জীবন কাটছে, কেউ পাশে নেই।

হোয়াইক্যং ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান নুর আহমদ আনোয়ারী বলেন, রোহিঙ্গাদের ভেতরে চাকমারা অস্বস্তিতে থাকেন, কোথাও সরানোর ব্যবস্থা নেই। চাকমা শিশুদের পড়ালেখারও ব্যাঘাত ঘটছে। ফসল উৎপাদন বন্ধ এবং আয়রোজগার বন্ধ থাকায় চাকমারা দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছেন।

উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের অর্ধেক এলাকাজুড়ে গড়ে উঠেছে এক লাখ রোহিঙ্গার চারটি আশ্রয়শিবির। শিবিরগুলোর ভেতরে পড়েছে ৩৫০ পরিবারে অন্তত দুই হাজার বাংলাদেশি। পালংখালী ইউপির চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, আশ্রয়শিবিরগুলোয় প্রায় প্রতিদিন রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের মধ্যে গোলাগুলি, সংঘর্ষ, অপহরণ ও মারামারির ঘটনা ঘটছে। খুনোখুনির ঘটনাও অহরহ। তা ছাড়া পরিকল্পিতভাবে আগুন দিয়ে রোহিঙ্গা শিবির ধ্বংস করা হচ্ছে। তাতে বাংলাদেশিরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। বিশেষ করে নারী-শিশুদের ২৪ ঘণ্টা আতঙ্কে থাকতে হচ্ছে। বসতিগুলোর চারদিকে কাঁটাতারের বেড়া থাকায় বাংলাদেশিদের স্বাভাবিক জীবনযাপন ব্যাহত হচ্ছে। আন্দোলন–সংগ্রাম করেও আটকে পড়া বাংলাদেশিরা সমাধান পাচ্ছেন না।

উখিয়ার জুমশিয়া আশ্রয়শিবিরের ভেতর বন্দিজীবন কাটাচ্ছেন প্রায় ৪০০ পরিবারের আড়াই হাজার বাংলাদেশি। অধিবাসীদের সবাই উখিয়ার রাজাপালং ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা।

স্থানীয় ইউপি সদস্য হেলাল উদ্দিন বলেন, দীর্ঘ ছয় বছর ধরে বাংলাদেশিরা অমানবিক জীবন কাটাচ্ছেন। কাঁটাতার দিয়ে পরিবারগুলো ঘিরে রাখায় ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করতে পারছেন না। অধিকাংশ পরিবার টমটম, অটোরিকশা চালিয়ে ও দোকানপাট করে জীবিকা নির্বাহ করত। কয়েক বছর ধরে সবকিছু বন্ধ। রোহিঙ্গারা ত্রাণসহায়তা পেলেও বাংলাদেশিরা সবকিছু থেকে বঞ্চিত। রোহিঙ্গাদের অন্যত্র সরানো দাবিতে বাংলাদেশিরা আন্দোলন করেও ফল পাচ্ছেন না।

জুমশিয়ার বাসিন্দা আমিন হোসেন (৪৫) বলেন, পরিবারের কেউ হঠাৎ অসুস্থ হলে উখিয়া সদরের হাসপাতালে নেওয়া যায় না। জরুরি প্রয়োজনে বাড়ি থেকে আশ্রয়শিবিরের বাইরে যাতায়াত করা যায় না। ছেলেমেয়েরা স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসায় সঠিক সময়ে পৌঁছতে পারে না। রোহিঙ্গাদের মতো বাংলাদেশিদেরও একাধিক তল্লাশিচৌকিতে থামতে হয়। পরিচয় শনাক্ত করার পর যাতায়াতের অনুমতি মেলে। সন্ধ্যার পর বাড়ি থেকে ক্যাম্পের বাইরে যাতায়াত বন্ধ থাকে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক বাসিন্দা বলেন, তাঁর এক মেয়ে স্নাতক শেষ করে ঘরে রয়েছেন। ইতিমধ্যে মেয়ের বিয়ের কয়েকটা প্রস্তাব এলেও আশ্রয়শিবিরের ভেতরের বসতিতে বাইরের লোকজনের প্রবেশ নিষিদ্ধ থাকায় বিয়ে ভেঙে গেছে। ছেলেদের জন্য বউ হিসেবে বাইরের মেয়েদের ঘরে আনা যাচ্ছে না।

অষ্টম শ্রেণিপড়ুয়া এক মেয়ে জানায়, রোহিঙ্গাবসতির ভেতর দিয়ে কয়েক কিলোমিটার ঘুরে তাকে স্কুলে আসা–যাওয়া করতে হয়। রোহিঙ্গাদের মধ্যে গোলাগুলি-সংঘর্ষ বাধলে কয়েক দিন স্কুলে যাওয়া হয় না।

রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের দাবিতে সবশেষ গত ১৮ মার্চ উখিয়ার কুতুপালং বাজারের প্রধান সড়কে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল করেন কাঁটাতারের বেড়ার ভেতরে বন্দিজীবনে থাকা প্রায় ৮০০ বাংলাদেশি। মানববন্ধন থেকে বেশ কিছু দাবি তুলে ধরা হয়। এর মধ্য রয়েছে লম্বাশিয়া রোহিঙ্গা শিবির দ্রুত অন্যত্র স্থানান্তর, আশ্রয়শিবিরের অভ্যন্তরে স্থানীয় বাসিন্দাদের অবাধে চলাচলের সুযোগ, জানমালের নিরাপত্তা, শিক্ষার্থীদের অবাধে যাওয়া-আসার ব্যবস্থা, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ও সিএনজিচালিত অটোরিকশা চলাচলের সুযোগ দেওয়া, চাষের জমিতে আশ্রয়শিবির থেকে আসা বর্জ্য অপসারণ।

শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরঅরসি) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরের ভেতরে কয়েক হাজার বাংলাদেশির ঘরবাড়ি রয়েছে। বাড়িগুলো কাঁটাতারের ভেতরে পড়ে যাওয়ায় সমস্যা দেখা দিচ্ছে। বাংলাদেশিরা স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারছেন না। কিন্তু বাংলাদেশিদের সরিয়ে নেওয়া কিংবা রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের বিষয়ে তাঁর করার কিছু নেই। বিষয়টি জেলা প্রশাসনের এখতিয়ারে পড়ে।

এ প্রসঙ্গে জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শহীন ইমরান প্রথম আলোকে বলেন, আশ্রয়শিবিরগুলোর ভেতরে কতজন বাংলাদেশি রয়েছেন, তাঁদের আশপাশে কতজন রোহিঙ্গার বসতি আছে, কার কী সমস্যা, তা অনুসন্ধানের জন্য কমিটি গঠন করা হয়েছে। অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে কমিটিতে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন, উপজেলা প্রশাসন, ফায়ার সার্ভিস বাহিনী ও জনপ্রতিনিধি রাখা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন হাতে এলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।