দুই যুবক গাছের সঙ্গে বাঁধা। দুজনকে ঘিরে গোটা বিশেক লোকজন। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ লাঠি দিয়ে যুবকদের পেটাচ্ছেন। কেউ আবার পিটুনিতে হওয়া ক্ষতস্থানে লাগিয়ে দিচ্ছেন মরিচের গুঁড়া। অনেকেই সেই ক্ষতস্থানে দিচ্ছেন লবণ। চিৎকার করছেন দুই যুবক। ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চুরির অভিযোগে দুজনকে এমন নির্যাতন করা হয়েছে।
গাজীপুরের শ্রীপুরে এমন ঘটনার একটি ভিডিও গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। ২ মিনিট ১৪ সেকেন্ডের ভিডিওয়ের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দুই যুবকের আর্তনাদ শোনা যায়। এ সময় তাঁদের রক্ষা করতে কাউকে এগিয়ে আসতে দেখা যায়নি। নির্যাতনের সময় সেখানে শিশু ও নারীদের দেখা গেছে।
ভিডিওয়ের এমন ঘটনা সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে দুই যুবকের পরিচয় পাওয়া গেছে। তাঁদের একজন মাইনুদ্দিন সোহেল (২৬)। তিনি ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার ভাতাদিয়া গ্রামের সেলিম মিয়ার ছেলে। মাইনুদ্দিন শ্রীপুরের সাইটালিয়া গ্রামের ইরেক্টস পুলস অ্যান্ড স্ট্রাকচারস লিমিটেড নামের একটি কারখানায় চাকরি করেন। কারখানার ভেতরে শ্রমিকদের আবাসিক ভবনেই থাকেন। অন্য যুবক হলেন আলমগীর হোসেন (২৪)। তিনি শ্রীপুর উপজেলার আবদার গ্রামের আছিম উদ্দিনের ছেলে। তিনিও একই কারখানায় চাকরি করেন।
ঘটনাটি ২৯ অক্টোবরের। শ্রীপুরের আবদার গ্রামের সাইলাপাড়া এলাকার মো. ফাইজুদ্দিনের বাড়ির পাশে ওই দুই যুবককে সেদিন সকাল সাড়ে ছয়টা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়েছে। পরে তাঁদের কাছ থেকে ৩০ হাজার টাকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে বলে স্বজনেরা জানিয়েছেন।
গতকাল রাত ৯টার দিকে আবদার গ্রামের মো. তাইজুদ্দীনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, নির্যাতনের শিকার মাইনুদ্দিন সোহেল সেখানে অবস্থান করছেন। ওই বাড়ির একটি কক্ষে ভাড়া নিয়ে তাঁর ভাই মো. মহিউদ্দিন স্থানীয় একটি কারখানায় চাকরি করেন। নির্যাতন থেকে মুক্তি পাওয়ার পর থেকেই মাইনুদ্দিন আহত অবস্থায় মহিউদ্দিনের ভাড়া বাসায় আছেন।
কাঁদতে কাঁদতে ঘটনার বর্ণনা দিয়ে মাইনুদ্দিন সোহেল বলেন, গত মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে তিনি ও আলমগীর কারখানার মূল ফটকের বাইরে চা খেতে যান। এ সময় কয়েকজন মিলে তাঁদের সেখান থেকে ধরে নিয়ে যান। প্রথমে পাশের একটি জঙ্গলে নিয়ে তাঁদের ব্যাপক মারধর করা হয়। পরে সেখান থেকে একটি বাড়ির পাশে নিয়ে গাছে বেঁধে রাখা হয়।
শ্রীপুরের আবদার গ্রামের সাইলাপাড়া এলাকার মো. ফাইজুদ্দিন ও তাঁর বাড়ির লোকজন এই নির্যাতন করেছেন। তাঁরা লাঠি দিয়ে পিটিয়ে প্রথমে জখম করেন তাঁদের। পরে সেই ক্ষতস্থানে লবণ ও মরিচের গুঁড়া মেখে দেন। একপর্যায়ে তাঁদের চোখে মরিচের গুঁড়া মেখে দেওয়া হয়।মাইনুদ্দিন সোহেল, নির্যাতনের শিকার হওয়া যুবক
মাইনুদ্দিন সোহেলের দাবি, একটি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চুরির অপবাদ দিয়ে তাঁদের দুজনকে চরম নির্যাতন করা হয়েছে। শ্রীপুরের আবদার গ্রামের সাইলাপাড়া এলাকার মো. ফাইজুদ্দিন ও তাঁর বাড়ির লোকজন এই নির্যাতন করেছেন। তাঁরা লাঠি দিয়ে পিটিয়ে প্রথমে জখম করেন তাঁদের। পরে সেই ক্ষতস্থানে লবণ ও মরিচের গুঁড়া মেখে দেন। একপর্যায়ে তাঁদের চোখে মরিচের গুঁড়া মেখে দেওয়া হয়। তাঁরা সইতে না পেরে তীব্র চিৎকার দিয়ে ছটফট করলেও তাঁদের ক্ষমা করা হয়নি। খবর পেয়ে তাঁর ভাই মহিউদ্দিন ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন। অনেকের হাতে-পায়ে ধরেন কিন্তু তবুও মন গলেনি সেখানে উপস্থিত লোকজনের। মাইনুদ্দিন আরও বলেন, ‘আমাকে মারতে মারতে বারবার অটোরিকশা চুরি করে কোথায় রেখেছি, তা জানতে চাইছিল। অথচ আমি এসবের কিছু্ই জানি না।’
মাইনুদ্দিনের ভাই মো. মহিউদ্দিন বলেন, তিনি অনেকের হাতে-পায়ে ধরলেও কেউ তাঁদের ছাড়তে নারাজ। একপর্যায়ে এক লাখ টাকা দিলে ছেড়ে দেওয়া হবে বলে নির্যাতনকারী ব্যক্তিরা জানান। এত টাকা জোগাড় করা তাঁদের পক্ষে অসম্ভব নয় জানালে নির্যাতনের পরিমাণ বাড়িয়ে দেওয়া হয়। পরে বাধ্য হয়ে তিনি বাড়িতে ফোন দিয়ে ঘটনা জানান। এরপর মাইনুদ্দিনের স্ত্রী তাঁর সোনার গয়না বিক্রি করে ৩০ হাজার টাকা পাঠান। সেই টাকা নির্যাতনকারীদের একজনের কাছে দেওয়ার পর তাঁদের দুজনকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
মো. মহিউদ্দিন জানান, বেলা একটার দিকে জাতীয় জরুরি সেবার ৯৯৯ নম্বরে ফোন করে বিষয়টি জানান। পরে শ্রীপুর থানা থেকে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়েছিল। নির্যাতনে আহত দুজনকে চিকিৎসার জন্য নির্যাতনকারী ব্যক্তিদের নির্দেশ দিয়েছিল পুলিশ। কিন্তু তাঁরা পুলিশের কথা না রেখে দুজনকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আটকে রাখেন।
যে অটোরিকশা চুরি হয়েছে, সেই অটোরিকশার মালিক ফাইজুদ্দিন বলেন, গত ২৫ অক্টোবর দুই যুবক তাঁর একটি অটোরিকশা ভাড়া নিয়ে কাওরাইদ, বরমী, শ্রীপুরসহ বিভিন্ন স্থানে ঘোরাঘুরি করেন। একপর্যায়ে পানীয়ের সঙ্গে নেশা জাতীয় কোনো দ্রব্য খাওয়াইয়ে চালকের কাছ থেকে অটোরিকশা ছিনিয়ে নিয়ে যান। তিনি অটোরিকশা উদ্ধারে চালককে নিয়ে বিভিন্ন স্থানে যান। একপর্যায়ে চালকই ওই দুই যুবককে শনাক্ত করেন। পরে দুজনকে ধরে এনে এলাকার শত শত মানুষ মারধর করেছেন। তাঁর কিছুই করার ছিল না।
এ বিষয়ে শ্রীপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জয়নাল আবেদীন মণ্ডল প্রথম আলোকে বলেন, খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পুলিশ পাঠানো হয়। এ ঘটনায় থানায় কেউ কোনো অভিযোগ করেননি। অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।