হেমন্তের শেষ ভাগে ব্রহ্মপুত্র থেকে বয়ে আসছে হিমেল হাওয়া। এর মধ্যে চুলায় গরম তেলে নানা জাতের বড়া ভাজছিলেন শিরিন বেগম (৫০)। মুখরোচক সে খাবার খেতে ভিড় করে আছেন তরুণেরা। শিরিনের পাশেই চা বিক্রি করছিলেন তাঁর পুত্রবধূ রুমানা আক্তার (২৫)। দারিদ্র্যমাখা সংসারের হাল ধরতে যুগপৎভাবে প্রতিদিন সংগ্রাম করে যাচ্ছেন এই দুই নারী।
শুক্রবার রাত ৯টার দিকে ময়মনসিংহ নগরের শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন উদ্যানসংলগ্ন ব্রহ্মপুত্র নদের বেড়িবাঁধের নিচে এই দুই নারীর সঙ্গে দেখা হয়। তাঁরা সেখানে দোকান দিয়েছেন। দোকানের আয়েই চলে তাঁদের সংসার।
শিরিন বেগমের স্বামী ময়মনসিংহ নগরের কাঁচিঝুলি এলাকার বাসিন্দা ফরহাদ মিয়া। বছর দশেক ধরে প্যারালাইজড তিনি। এর মধ্যেই টাউন হল মোড়ে ছোট একটি টংদোকানে পান-সিগারেট বিক্রি করতেন তিনি। মাস তিনেক আগে সে দোকানটি ভাঙা পড়লে কর্মহীন হয়ে পড়েন। শিরিন ও ফরহাদের তিন সন্তান। এর মধ্যে বড় ছেলে বাক্ ও শারীরিক প্রতিবন্ধী। ছোট ছেলে কর্মহীন। মেয়ের বিয়ে হলেও তিনি স্বামীকে নিয়ে বাবার বাড়িতে থাকেন। সংসারে অনেক মানুষ, কিন্তু উপার্জনক্ষম মানুষ কম। ফলে বাধ্য হয়েই জীবিকার সন্ধানে নেমে পড়েন শিরিন।
গত দুই মাস হলো শিরিন বেগম নগরের জয়নুল উদ্যানে বেড়িবাঁধের নিচে ত্রিপল টানিয়ে বড়া বিক্রির দোকান দিয়েছেন। তাঁর দোকানে বেগুনি, ধনেপাতার বড়া, বিভিন্ন ধরনের শাকের বড়া, চিংড়ির বড়া, ফুলকপির বড়া, ডালের পেঁয়াজু, আলুর চপ ও কুমড়ার বড়া তৈরি করা হয়। প্রতিদিন বিকেল চারটার দিকে দোকান শুরু করে রাত ৯টা পর্যন্ত বিক্রি করেন। এ সময়ের মধ্যে ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা বিক্রি হয়।
গতকাল রাতে শিরিন বেগমের দোকানে গিয়ে দেখা যায়, ক্রেতারা যে পদের বড়া খেতে চাচ্ছেন, গরম তেলে সেই বড়া ভেজে দিচ্ছেন তিনি। অনেকে সেখানে দাঁড়িয়ে খাচ্ছেন, আবার অনেকে নিয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের একজন জাহাঙ্গীর আকন্দ। তিনি বলেন, ‘শীতের রাতে গরম-গরম বড়া ভাজা বেশ স্বাদের লেগেছে। খাবারের মানও ভালো।’
শিরিন বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্বামীর দোকান ভেঙে দেওয়ার পর কিছু একটা করার চিন্তা শুরু হয়। কারণ, মানুষের কাছে হাত পাতা শরমের। পরিবার নিয়ে নিজে যেন সচ্ছলভাবে চলতে পারি, সে কারণে এখানে দোকান করছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘মাইনসের কাছে হাত পাতন ভালো না, হাত পাতনের চেয়ে দোকান করছি। আল্লায় খুব ভালো রাখছে।’
শিরিন বেগমের দোকানের পাশেই পুত্রবধূ রুমানা আক্তারের চায়ের দোকান। ১১ বছর আগে শিরিনের বড় ছেলে রুমান মিয়ার (৩০) সঙ্গে রুমানা আক্তারের বিয়ে হয়। রুমান মিয়া বাক্ ও শারীরিক প্রতিবন্ধী। রুমানা আক্তারের নামটি বিয়ের পরে দেওয়া হয়েছে। তাঁর মা-বাবার দেওয়া নাম পপি আক্তার। রুমান-রুমানার দুই মেয়ে ও এক ছেলে আছে।
রুমানা আক্তার বলেন, ‘সন্তানদের জীবন গড়তে ছয় বছর ধরে এই পার্কে চা বিক্রি করছি। প্রতিদিন সকাল সাড়ে ছয়টায় আসি, রাত ১০টায় বাড়িতে যাই। বাচ্চাদের শাশুড়ি ও ননদ দেখাশোনা করে। চা বিক্রি করে প্রতিদিন খরচ ছাড়াই হাজার টাকা আয় করি। সন্তানদের পড়ালেখা করিয়ে ভালো মানুষ হিসেবে বড় করতে চাই। নিজের কষ্টের আয়ে স্বামী-সন্তান নিয়ে ভালো চলে যাচ্ছে দিন।’
এ সময় ওই দোকানে যান সংস্কৃতিকর্মী শামীম আশরাফ। তিনি বলেন, ‘যেখানে বউ-শাশুড়ির অসংখ্য ভাঙনের গল্প আমরা টিভি সিরিয়াল ও বাস্তব জীবনে দেখি, সেখানে তাঁরা সহযোদ্ধার মতো একটি সংসারের হাল ধরে আছেন। সংসারে সবার মুখে হাসি ফোটানোর এমন দৃশ্য দেখে আনন্দিত না হয়ে পারা যায় না। এই নারীরা জীবনযুদ্ধে হার না মেনে জয়ী হওয়ার পথে। অনেক তরুণ হতাশায় ভোগেন। এই নারীরা হতে পারেন তাঁদের প্রেরণা।’