তারুণ্যের সময়টিকে ধরে রেখেছেন তিনি। এখনো গান লেখেন, মঞ্চে উঠে গান ধরেন। গান ও সুরের টানে ছুটে বেড়ান নানা প্রান্তে।
খালি গলাতেই গান ধরলেন, ‘তুমি যাইতে চাইলে যাও রে বন্ধু, নিষেধ করি না/ তোমার হাতের বাঁশি থইয়া যাইও, লইয়া যাইও না।’ তাঁর গলায়, চোখে-মুখে টগবগ করে ফুটছিল কথা ও সুর। বয়স হয়েছে, গান শুনে তা বোঝার উপায় নেই। তারুণ্যের সময়টিকে ধরে রেখেছেন মনে। এখনো গান লেখেন, মঞ্চে উঠে গান ধরেন। গান ও সুরের টানে ছুটে বেড়ান নানা প্রান্তে।
তিনি চারণকবি, গীতিকার মো. সিরাজ উদ্দিন (৭২)। বাড়ি মৌলভীবাজারের বড়লেখার সুজানগর ইউনিয়নের ভাড্ডায়। সেখানেই জন্ম, বেড়ে ওঠা, ঘর-গেরস্তি, কবিতা-গানেরও প্রকাশ। বয়সের শেষ প্রান্তে এসে সেই গানেই প্রাণ খুঁজে পান এই চারণকবি, গীতিকার, লোকশিল্পী।
গত ১৮ জুলাই মৌলভীবাজার শহরে চারণকবি সিরাজ উদ্দিনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গ্রামের স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতেই তিনি থমকে গেছেন। কিন্তু সেই সময় থেকে আরও বড় পাঠশালার ছাত্র হয়ে গেলেন তিনি। প্রকৃতির পাঠশালা থেকেই তিনি দুই হাতে কুড়িয়েছেন কথা, সুর। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই তাঁর মধ্যে ছিল গান, কবিতার প্রকাশ। গান গাইতে গিয়ে কোথাও ভুলে গেলে নিজেই বানিয়ে ফেলতেন নতুন লাইন।
শিক্ষকেরা বলতেন, ‘তুই তো কবি হবি রে।’ এত দিনে ঠিকই তিনি তাঁর চেনা অঞ্চলের লোক আত্মাকে কথা ও সুরে ফুটিয়ে চারণকবির পরিচিতিকে গলার হার করেছেন। মানুষের সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততার আরও দিক আছে, ১৯৮৮ সালে সুজানগর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।
ভালো ফুটবল খেলোয়াড় ছিলেন। পাঁচ ছেলের তিনজন মধ্যপ্রাচ্যপ্রবাসী, দুজন সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালক। দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। সরকারিভাবে তিনি নিয়মিত কল্যাণ ভাতা পান।
তাঁর মনে আছে, আমিন আলী নামের এক ব্যক্তি কবিতা লিখতেন। তাঁদের এলাকায় এসে সেই কবিতা পাঠ করতেন, বেচতেন। আমিন আলীর কাছ থেকে তিনি কবিতা এনে বিক্রি করতেন। এটা ১৯৭৩-৭৪ সালের ঘটনা। একদিন আমিন আলী তাঁকে (সিরাজকে) দিলেন, ‘যদি নিজে লিখতে পারো, তাইলে আমার কাছে আইও।’
বড়লেখা নারীশিক্ষা একাডেমি ডিগ্রি কলেজের ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক এম এ হাসান তাঁর একটি লেখায় বলেছেন, কবি সিরাজ হাট-বাজারে নিজের কবিতা-কাহিনি যখন পাঠ করতেন, তখন সর্বস্তরের জনসাধারণ দাঁড়িয়ে তাঁর কবিতাপাঠ শুনতেন। তাঁর কবিতাপাঠ এতই মধুর ছিল, মানুষকে চুম্বকের মতো ধরে রাখত।
সিরাজ উদ্দিন বলেন, ‘সাত-আট বছর তিনি এ রকম কবিতা লিখেছেন। ফাঁকে স্থানীয় একজন শিল্পী ইয়াকুব আলীর কাছে গান শিখেছেন। ৩০-৩২ বছর আগে হঠাৎ করেই তিনি কাহিনি-কবিতা থেকে গানে চলে এলেন। তাঁর কাহিনি-কবিতা ছাপতে গিয়েছিলেন সিলেটের একটি প্রেসে। সেখানে বাউল শাহ আবদুল করিমের সঙ্গে দেখা। আবদুল করিম কবিতা দেখে তাঁকে উপদেশ দিলেন গান লিখতে।
২০১৮ সালে হৃদয় সংগীত নামে তাঁর একটি গানের বই প্রকাশিত হয়েছে। এতে নানা বিষয়ের ২০০ গান আছে। আরও ছয় শতাধিক গান আছে অপ্রকাশিত।