কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের আশ্রয়শিবিরগুলোতে প্রায় ৮০০ আখড়ায় মাদকদ্রব্য কেনাবেচায় জড়িত অন্তত পাঁচ হাজার রোহিঙ্গা। দেশের ইয়াবা ও আইসের কারবার রোহিঙ্গা মাদক কারবারিরা নিয়ন্ত্রণ করলেও পাঁচ বছরে তাঁদের চিহ্নিত করা যায়নি। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর কিছু সদস্যের যোগসাজশে রোহিঙ্গারা দেশটি থেকে ইয়াবা ও ক্রিস্টাল মেথ আইসের বড় চালান আশ্রয়শিবিরগুলোতে নিয়ে আসছে বলে অভিযোগ আছে।
গত পাঁচ বছরে মাদক চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ, আধিপত্য বিস্তার ও চাঁদার টাকা ভাগাভাগি নিয়ে নিজেদের মধ্যে কোন্দল, সংঘর্ষ, গোলাগুলি এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধ’র ঘটনা মিলিয়ে অন্তত ১২৩ জন রোহিঙ্গা নিহত হয়েছেন।
গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন বলছে, পরিস্থিতি আরও অবনতি দিকে যেতে পারে। মিয়ানমার সীমান্ত থেকে অস্ত্র, মাদক সরবরাহ করে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে সক্রিয় রাখছে।
বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩ আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখ। এর মধ্যে ৮ লাখ এসেছে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পরের কয়েক মাসে।
পুলিশ ও গোয়েন্দা সূত্র জানায়, ইয়াবা ও আইসের কারবার নিয়ন্ত্রণ এবং মাদকের টাকা ভাগাভাগি নিয়ে আশ্রয়শিবিরে মিয়ানমারের সশস্ত্রগোষ্ঠী ‘আরাকান স্যালভেশন আর্মির (আরসা)’ সঙ্গে অন্তত নয়টি রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী বাহিনীর প্রায়ই গোলাগুলি, খুন ও অপহরণের ঘটনা ঘটছে। শিবিরে রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসী বাহিনী আছে ১৪টির বেশি।
শুরুর দিকে আশ্রয়শিবিরের নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল উখিয়া ও টেকনাফ থানার পুলিশ। ২০২০ সালের ১ জুলাই থেকে নিরাপত্তা দায়িত্বে আসে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন)। তিনটি পৃথক ব্যাটালিয়নে এপিবিএন সদস্য রয়েছেন ২ হাজার ২০০ জন।
১৪ এপিবিএন অধিনায়ক ও পুলিশের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক (অ্যাডিশনাল ডিআইজি) সৈয়দ হারুন অর রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, ক্যাম্পে মাদক চোরাচালান ঘিরে সেখানে কয়েকটি গোষ্ঠী তৎপর। মাদক চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ ও শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষায় কাজ করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ড্রোন উড়িয়ে সন্ত্রাসীদের শনাক্ত ও গ্রেপ্তার অভিযান চালানো হচ্ছে।
পুলিশের তথ্যমতে, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ২০ আগস্ট পর্যন্ত সাড়ে সাত মাসে কয়েকটি শিবিরে আরসার সঙ্গে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের গোলাগুলির ঘটনায় খুন হয়েছে আটজন রোহিঙ্গা। মুক্তিপণের জন্য অপহরণ করা হয়েছে ৩৩ জনকে এবং ধর্ষণের শিকার হয়েছেন তিন রোহিঙ্গা তরুণী।
আর ২০১৭ সালে ২৫ আগস্ট থেকে ২০২২ সালের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত প্রায় পাঁচ বছরে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩ আশ্রয়শিবিরে ৯১ হত্যাকাণ্ডের বিপরীতে ৮১টি হত্যা মামলা হয়েছে। আসামি ৩৮৪ জন। এর বাইরে আরও ৩২ জন রোহিঙ্গা খুন হয়েছেন নিজেদের বিভিন্ন বাহিনীর বন্দুকযুদ্ধে ও অপহরণের পর। এ ছাড়া ১৩২ জনের বিরুদ্ধে ধর্ষণ মামলা হয়েছে ৮৪টি। ১৭৬টি অস্ত্র মামলায় আসামি করা হয় ৪৮৭ জনকে।
এসব আশ্রয়শিবিরে ১৭ ধরনের অপরাধের বিপরীতে ৫ হাজার ২২৯ জন রোহিঙ্গার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ২ হাজার ৩০৯টি। এর মধ্যে মাদক আইনের মামলা ১ হাজার ৫৬৪টি—যাতে আসামি করা হয়েছে ২ হাজার ৩৮৫ জনকে।
কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো. হাসানুজ্জামান বলেন, আশ্রয়শিবিরে অতীতের তুলনায় মাদক ব্যবসা বেড়েছে। ইয়াবা ও আইসের চালান ধরা পড়ছে। উদ্ধার হচ্ছে অস্ত্রশস্ত্রসহ সন্ত্রাসীরা। কিন্তু ঘিঞ্জি পরিবেশের কারণে আশ্রয়শিবিরে খুন ও মাদকের কারবার নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না।
বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের সীমান্ত ২৮০ কিলোমিটার। এ স্থল ও জলসীমান্ত পাহারায় আছে বিজিবি ও কোস্টগার্ড। সীমান্তপথের অন্তত ৩৩টি চোরাই পয়েন্ট দিয়ে ইয়াবা ও আইসের বড় চালান ঢুকছে। প্রতিবছর কী পরিমাণ মাদকদ্রব্য ঢোকে এর সঠিক পরিসংখ্যান কোনো দপ্তরে নেই। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ধারণা, বছরে অন্তত ১০ হাজার কোটি টাকার মাদক ঢুকছে দেশে। এর ৭০ শতাংশ ইয়াবা। এখন ইয়াবার স্থান নিচ্ছে আইস।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত সাত মাসে কক্সবাজারের বিজিবি-কোস্টগার্ড, র্যাব, পুলিশ, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন বাহিনী উদ্ধার করেছে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার মাদকদ্রব্য। জাতিসংঘের মাদক নিয়ন্ত্রণ সংস্থা ইউএনওডিসির মতে, যত মাদক বিক্রি হয়, ধরা পড়ে এর মাত্র ১০ শতাংশ।
জানতে চাইলে টেকনাফ ২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল শেখ খালিদ মোহাম্মদ ইফতেখার প্রথম আলোকে বলেন, বিজিবির তৎপরতা ও সক্ষমতা—দুটিই বেড়েছে। এ কারণে ইয়াবা ও আইসের বড় বড় চালান ধরা পড়ছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন সূত্র জানায়, মিয়ানমারে ইয়াবা তৈরির কারখানা আছে ২৯টির বেশি। এসব কারখানায় উৎপাদিত ইয়াবার সিংহভাগ পাচার হয় বাংলাদেশে। এ ছাড়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মাদক তালিকায় জেলার ১ হাজার ১৫১ জনের নাম রয়েছে। এর মধ্যে টেকনাফেই ৯১২ জন। তালিকার শীর্ষে ৭৩ জন ইয়াবা কারবারির ৬৫ জন টেকনাফের।
সূত্রগুলোর তথ্যমতে, গত পাঁচ বছরে আশ্রয়শিবিরে মাদক কারবারির সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে পাঁচ হাজারের মতো। উখিয়া, টেকনাফ, রামু ও নাইক্ষ্যংছড়িতেও নতুন কারবারি তৈরি হয়েছে কয়েক হাজার। তালিকা না থাকায় ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে মাদক কারবারিরা।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর কক্সবাজার কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. রুহুল আমিন বলেন, আশ্রয়শিবিরে মাদকের আখড়া ও কারবারির সংখ্যা বাড়লেও এ পর্যন্ত তালিকা হয়নি। জনবলসংকটের কারণে সেখানে অভিযানও চালানো যাচ্ছে না।
পুলিশের দেওয়া তথ্যমতে, গত পাঁচ বছরে আশ্রয়শিবিরে ২ হাজার ৩৮৫ জন রোহিঙ্গার বিরুদ্ধে মাদক আইনে মামলা হয়েছে ১ হাজার ৫৬৪টি। এর মধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন অন্তত ৭৮০ জন।
আশ্রয়শিবিরের মাদক ব্যবসায় জড়িত আরসাসহ রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের বাহিনী আছে অন্তত ১৫টি। এর মধ্যে নবী হোসনের (৪৯) ইশারায় চলছে ৯টি। এগুলো হচ্ছে মাস্টার মুন্না, আসাদ, জুবাইর, হাকিম, জাবু, ইসলাম, মুমিন, জাকির ও শফিউল্লাহ বাহিনী।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্র জানায়, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ঘনিষ্ঠজন নবী হোসেন উখিয়ার বালুখালী আশ্রয়শিবিরে অবস্থান করে ইয়াবা ও আইসের কারবার চালাতেন। তাঁর দুই ভাই ভুলু ও কামালের নেতৃত্বে এবং রোহিঙ্গা নেতা হাফেজ ইদ্রিস, মোহাম্মদ সেলিম, মোহাম্মদ আয়াছ, কামাল হোসেনসহ অন্তত ২৩০ সদস্যের তত্ত্বাবধানে চলে ইয়াবা ও আইসের কারবার। গত মার্চ মাসে নবীকে ধরিয়ে দিতে ১০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে সীমান্ত জনপদে পোস্টার সাঁটে কক্সবাজারের ৩৪ বিজিবি। এরপর তিনি ক্যাম্প ছেড়ে মিয়ানমারে অত্মগোপন করে কারবার চালাচ্ছেন।
কক্সবাজার ৩৪ বিজিবি অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মেহেদি হোসাইন কবির বলেন, আশ্রয়শিবিরকেন্দ্রিক ইয়াবা, আইস, অস্ত্রের বড় অংশের নিয়ন্ত্রণ নবী হোসেনের হাতে। তাঁকে ধরতে পারলে মাদক চোরাচালান অনেকাংশে কমে যেত। একই সঙ্গে কারবারে জড়িত মূল হোতাদেরও শনাক্ত করা যেত।