মৌলভীবাজার শহরের বাইরে বের হতেই টের পাওয়া যায় ‘কার্তিকের নবান্নের দেশে’ শীত ও কুয়াশাকে সঙ্গে নিয়ে অগ্রহায়ণও চলে এসেছে। সড়কের দুই পাশে ধানের সবুজ লাবণ্যে অনেকটাই পরিবর্তন চলছে। কোথাও সবুজের হালকা ছোঁয়া, কোথাও হলুদের মতো বিস্তীর্ণ আঁচল মেলেছে মাঠ। এর মধ্যেই হেমন্তের সোনার সকাল মৃদু আলো হয়ে ঝরে পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে ধানের খেতে। অনেক দূরে, পূর্ব দিগন্তে সূর্য ক্রমে বিস্তৃত হয়ে আকাশের বুক থেকে তাপ ছড়ানোর আয়োজন করছে।
শনিবার সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে লাল শাপলা দেখতে মৌলভীবাজার-কুলাউড়া সড়ক ধরে যাওয়ার পথে দুই পাশে হালকা কুয়াশার চাদর ছিল। কুয়াশামোড়া গ্রামগুলোকে মনে হয়েছে তখনো ঘুমকাতুরে, ঝিম ধরে আছে। আলো ফুটতে থাকায় সকালের ধানের খেত তখন একটু একটু করে ঘোমটা খুলতে শুরু করেছে। রাজনগর-ফেঞ্চুগঞ্জ-সিলেট আঞ্চলিক মহাসড়কের মুন্সীবাজার থেকে পশ্চিম দিকে গ্রামের ভেতরের দিকে একটা সড়ক গেছে। এই সড়ক দিয়ে হয়তো অনেক গ্রামেই যাওয়া যায়, যাওয়া যায় কাউয়াদীঘি হাওরপারের গ্রামগুলোতেও।
কুচিমোড়া খালের সেতুর কাছে বেশ কজনের সঙ্গে দেখা। তাঁদের কেউ কাঁধে সেঁউতি, কেউ মাছ রাখার খালই হাতে মাঠের দিকে চলছেন। কাউয়াদীঘি হাওরপারের গ্রাম এই এলাকা। হাওরের পানি নেমে যাওয়ায় খাল-বিল, ডোবা-নালা ভেসে উঠছে। মানুষ মাছ ধরতে যাঁর যাঁর মতো আয়োজন করছেন। কেউ ডোবার মাছ ধরতে সেচ দিচ্ছেন। কেউ জাল পেতে মাছ ধরছেন।
এই এলাকায় কিছুদিন আগেও যে পানির দাপট ছিল, তা বুঝতে সমস্যা হয় না। পানি নেমে যাওয়ায় ভেসে ওঠা খেতে শাপলা-শালুকের গাছ তখনো মরে যায়নি। কোথাও মাটির সঙ্গে পাতা লেপটে আছে, কোথাও বোরো চাষের প্রস্তুতিতে চাষিরা শাপলা-শালুকের ঝাড় স্তূপ করে রেখেছেন। এগুলোই পচে মাঠে জৈব সারের জোগান দেবে। এর মধ্যেই এখানে-ওখানে থোকা থোকা লাল শাপলা ফুটে আছে। মাটির সঙ্গে মিলেমিশে থাকা ফুলগুলো মাঠের বুকে একেক থোকা লালের উল্লাস, যেন মাঠের রক্তাক্ত হৃদয়। অনেকগুলো সাদা বক তখন ওই মাঠে বিভিন্ন জায়গায় বসে আছে, কোনো ঝাঁক উড়াল দিয়ে স্থান বদল করছে। কিছু চিল উড়ছে আকাশে। একঝাঁক শামুকখোল আকাশের অনেকটা ওপর দিয়ে কোথাও সারা দিন কাটানোর ভ্রমণে বের হয়েছে।
শিক্ষক আবদুল আজিজ বলেন, কদিন আগেও এসব স্থানে অনেক শাপলা ছিল। শুধু লাল শাপলাই নয়, সাদা শাপলাও ছিল অনেক দূর পর্যন্ত। যত দূর চোখ গেছে, লাল ও সাদা শাপলা-শালুকে ভরা ছিল মাঠ। এখন পানি কমে গেছে। ফুলও কিছুটা কমেছে।
তবে মাঠ ভরা না থাকুক, কোথাও না কোথাও এখনো লাল শাপলা লাজুক মুগ্ধতা ছড়িয়ে মাঠকে রঙিন করছে, কারও না কারও চোখকে তাদের দিকে টানছে। ফরিদপুর গ্রামের ছোট হাওরের মাঠে এ রকমই মুগ্ধ করা শাপলার দেখা মেলে। ওখানে মন ভালো করা লাল-উজ্জ্বল ভালোবাসা যেন ফুটে আছে, হাসছে। জায়গাটি পড়েছে মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার মুন্সীবাজার ইউনিয়নে। কাছেই কাউয়াদীঘি হাওর। হাওরপারের গ্রাম এটি। মাঠের ভেতর সারা রাত ধরে শাপলারা হেসেখেলে পাপড়ি মেলেছে। তখনো সকাল হালকা কুয়াশায় জড়ানো, শান্ত। রোদের তেজ পাপড়িতে পড়েনি। রোদ বাড়লে একটা সময় হয়তো সবগুলো ফুল চোখ বুজবে। হেমন্তের সোনার সকালে তখন শাপলাগুলো কোথাও এক–দুটো, কোথাও ছোট ছোট দল বাঁধা কিশোরীর মতো দুলছে, নাচছে। আবার ঝাঁক ধরে দুলছে অন্যখানে।
অনেকগুলো লাল রঙের ফড়িং উড়ছে এক ফুল থেকে আরেক ফুলে। ওখানে কারও হাতের ছোঁয়া লাগেনি, কারও বিনিয়োগ নেই। আপন মনেই ফুটেছে এগুলো। সেই বর্ষার কোনো এক মুহূর্তে এগুলো ছোট হাওরে, হাওরপারের মাঠে মাঠে ফুটতে শুরু করেছিল। হয়তো একদিন হেমন্তের শেষে তারা আবার ঘুমিয়ে পড়বে, ফিরবে আরও এক বর্ষার কোনো এক সময়ে। সেই অপেক্ষায়ই থাকবে মাঠ।