উদ্বোধনের ১১ বছর পরও চালু হয়নি টঙ্গী নদীবন্দর

বন্দর–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এ বন্দর চালু হওয়ার পথে বাধা দুটি কম উচ্চতার সেতু। একটি সেতু বালু নদে, অপরটি আশুলিয়ার বেড়িবাঁধে।

  • উদ্বোধনের পর থেকে এখন পর্যন্ত বন্দরটিতে কোনো পণ্যবাহী জাহাজ আসেনি।

  • পুরো নদীবন্দর এলাকা সুনসান। নেই কোনো জাহাজ বা যাত্রীদের আনাগোনা।

কোনো জাহাজ না ভেড়ায় পড়ে আছে গাজীপুরের টঙ্গীর নদীবন্দরে গ্যাংওয়ে। সম্প্রতি তোলা ছবি

সাধারণত নদীবন্দরের কথা এলে চোখের সামনে ভেসে ওঠে কর্মব্যস্ত ও কোলাহলময় এক জায়গার চেহারা। যেখানে নোঙর করা পণ্যবাহী জাহাজের ভিড়, যাত্রীদের ওঠানামা আর কুলি-মজুরদের হাঁকডাক। কিন্তু এসবের ছিটেফোঁটাও নেই গাজীপুরের টঙ্গী নদীবন্দরে। উদ্বোধনের ১১ বছর পেরিয়ে গেলেও বন্দরটি পড়ে আছে নির্বিকার। কর্মীরাও পার করছেন অলস সময়। শুরু হয়নি বন্দরের কার্যক্রম।

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) তথ্য বলছে, নৌপরিহন মন্ত্রণালয় থেকে ২০০০ সালে ঢাকার চারপাশে নৌপথ চালুকরণ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। এর অংশ হিসেবে টঙ্গীর মিরাশপাড়ায় নির্মাণ করা হয় এ নদীবন্দর। ২০১২ সালের ২ জুন নদীবন্দরটির উদ্বোধন করা হয়। সে সময়ের নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান ঘটা করে এর উদ্বোধন করেন। একটি দোতলা সুরম্য ভবন, দুটি গ্যাংওয়ে ও বিশাল পন্টুন নিয়ে শুরু হয় এর কার্যক্রম। কিন্তু উদ্বোধনের পর থেকে এখন পর্যন্ত বন্দরটিতে কোনো পণ্যবাহী জাহাজ আসেনি। পণ্য ওঠানামা করেনি। পাশাপাশি বন্দরের কার্যক্রম না থাকায় সেখানে নেই যাত্রী, সাধারণ মানুষ বা কুলি-মজুরের ভিড়।

সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, টঙ্গীর মিরাশপাড়া এলাকায় তুরাগ নদের পাশ ঘেঁষে নির্মাণ করা হয়েছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের ইকোপার্ক। পার্কের সীমানাপ্রাচীরের ভেতরেই নদীবন্দর। পুরো নদীবন্দর এলাকা সুনসান। নেই কোনো জাহাজ বা যাত্রীদের আনাগোনা। নদীবন্দর ভবনের মূল ফটক বন্ধ। কেউ আছেন—জিজ্ঞাসা করলে একজন এসে ফটক খুলে দেন। এরপর ভেতরে প্রবেশ করে ভবনের নিচতলায় কাউকে পাওয়া যায়নি। ফাঁকা পড়ে আছে কিছু চেয়ার–টেবিল। সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে দু–তিন ব্যক্তিকে দেখা যায়। অলস বসে আছেন তাঁরা।

নদীবন্দরটিতে একটি গ্যাংওয়ে পড়ে আছে অযত্ন-অবহেলায়। ওঠার সিঁড়ি নেই। নেই কোনো পন্টুন। গত বছরের জানুয়ারিতেও নদীবন্দরটিতে সরেজমিনে যান এ প্রতিবেদক। তখনো বন্দরটিতে ছিল সুনসান পরিবেশ। তবে ছিল দুটি গ্যাংওয়ে ও একটি পন্টুন। এখন পন্টুন নেই। শুধু ফাঁকা পড়ে আছে একটি গ্যাংওয়ে। বন্দর কর্তৃপক্ষের একটি সূত্র প্রথম আলোকে জানায়, বন্দরটিতে কোনো কাজ না থাকায় পন্টুন ও গ্যাংওয়েগুলো পড়ে ছিল নির্বিকার। রোদ–বৃষ্টিতে নষ্ট হচ্ছিল। ছয়–সাত মাস আগে পন্টুন ও একটি গ্যাংওয়ে সরিয়ে নেওয়া হয় রাজধানীর আমিনবাজার এলাকায়।

বন্দরটির জন্য এখন পর্যন্ত ৯ জন কর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে দুজন কর্মকর্তা। বাকিরা প্রহরী, অফিস সহায়ক ও পরিচ্ছন্নতাকর্মী। বন্দরটির সহকারী পরিচালক মো. শাহ আলম প্রথম আলোকে বলেন, বন্দরটির কার্যক্রম এখনো শুরু না হওয়ার মূল কারণ দুটি কম উচ্চতার সেতু। একটি বালু নদে চানপাড়ায় ও অন্যটি আশুলিয়ার দৌড় বেড়িবাঁধ সেতু। দুটি সেতুরই উচ্চতা কম। বর্ষায় নদে পানি হলে উচ্চতা আরও কমে যায়। এসব কারণে জাহাজ দূরের কথা, সাধারণ ব্লাল্কহেডও আসতে পারে না। তাই বন্দরটি উদ্বোধনের পরও কার্যক্রম শুরু হয়নি।

নদীবন্দরটি উদ্বোধনের কয়েক বছর পর যাত্রীদের চলাচলের জন্য টঙ্গী থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত ওয়াটার বাস সার্ভিস চালু করা হয়। প্রথমে প্রতিদিনই একবার ওয়াটার বাস চলত। কিন্তু যাত্রী না পাওয়ায় ২০১৬ সালের দিকে এক দিন অন্তর এই ওয়াটার বাস চলাচল করে। এর কিছুদিন পর তা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়।

এরপর ২০২২ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর পাঁচটি দ্রুতগামী স্পিডবোট দিয়ে টঙ্গী নদীবন্দর থেকে ঢাকার বৃত্তাকার পথে স্পিডবোট সেবা চালু করা হয়। নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী এবং যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল এ সেবার উদ্বোধন করেন। কিন্তু সেবাটি এখন বন্ধ হয়ে গেছে।

নদীবন্দরটির কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে পড়েছে টঙ্গী বাজার, ঢাকার আবদুল্লাহপুর, স্টেশন রোড, বিসিক শিল্পনগরীসহ অসংখ্য ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও শিল্পকারখানা। এসব এলাকার ব্যবসায়ী, শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিক ও স্থানীয় ব্যক্তিদের দাবি, তাঁরা দিনের পর দিন নদীবন্দরটি সচলের দাবি জানিয়ে আসছেন। বিভিন্ন প্রয়োজনে প্রতিদিন তাঁদের মালামাল আনা–নেওয়া করতে হয়। তাতে খরচ বেশি হওয়ার সঙ্গে থাকে নানা ঝুঁকি। তবু এসব নিয়ে মাথাব্যথা নেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের।

টঙ্গী বাজার এলাকার বাসিন্দা গিয়াস সরকার প্রথম আলোকে বলেন, তুরাগ নদের পাড় থেকে আনারকলি সড়ক পর্যন্ত বিভিন্ন পণ্যের সাত থেকে আট হাজার দোকান ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। ২৫–৩০ বছর আগেও এসব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে মালামাল আনা–নেওয়ার একমাত্র মাধ্যম ছিল তুরাগ নদ। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মালামাল আনা–নেওয়া করতে প্রচুর টাকা ও সময় নষ্ট হয়। নদীবন্দরটি চালু থাকলে এ সমস্যা হতো না। বিশেষ করে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে খুব সহজে টঙ্গী বাজারে পণ্য আমদানি করা যেত।