লাবণী দাসের বিয়ে হয়েছিল ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময়। বিয়ের আগে জানতেন না যে তাঁর স্বামী বাক্প্রতিবন্ধী। আয়-রোজগারও তেমন করতে পারেন না। তখন ভাগ্যকে মেনে নিয়ে কষ্টের সংসার শুরু করেন। পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ার কারণে এসএসসি পরীক্ষাও দেওয়া হয়নি। সংসার চালাতে এর আগে লাবণী আট বছর কাগজের ফুল তৈরি করে বিক্রি করেছেন। আর ১১ বছর ধরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে বিক্রি করছেন ডাব।
লাবণী দাসের বাড়ি রাজশাহী নগরের আলুপট্টি এলাকায়। বাবার বাড়ি নওগাঁর মহাদেবপুরে। গতকাল রোববার সন্ধ্যায় রাজশাহী নগরের কুমারপাড়া মোড়ে কথা হয় লাবণী দাসের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘পরিবার বোধ হয় বোঝা খালি করার জন্য আমাকে বিয়ে দিয়েছিল। তা ছাড়া একজন প্রতিবন্ধী মানুষের সঙ্গে কেন বিয়ে দিল? যে লোকটাকে কেউ কোনো কাজে নেয় না। পেট্রলপাম্পে কাজ করত, কথা বলতে না পারার কারণে তাকে বাদ দিয়ে দেয়। কোনো উপায় না দেখে সংসার চালানোর জন্য আমি বাড়িতে বসে কাগজের ফুল তৈরি করে দোকানে বিক্রি করতে থাকি। আট বছর বসে বসে এই কাজ করার কারণে পিঠের ব্যথা শুরু হয়ে গেল। তারপর কাগজের ফুল বিক্রি করা বাদ দিই।’
লাবণী দাস বলেন, সংসার চালাতে ডাব কিনে মহল্লার মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিক্রি শুরু করেছিলেন। কিন্তু সারা দিন এই কাজ করে সন্ধ্যায় আর শরীর চলে না। বাধ্য হয়ে নগরের আলুপট্টির মোড়ে ভ্যানে করে ডাব বিক্রি শুরু করেন। সেখানে ভালো বিক্রি না হওয়ায় এখন নগরের কুমারপাড়া মোড়ে এসেছেন। প্রতিদিন ভোরে তাঁকে ডাবের সন্ধানে বের হতে হয়। ডাব আসে বরিশাল থেকে। কোনো দিন গাড়ি এসে নগরের তালাইমারীতে দাঁড়ায়, আবার কোনো দিন গাড়ি নগরের ডাশমারী এলাকায় দাঁড়ায়। যেখানে দাঁড়ায়, সেখান থেকেই ডাব নিয়ে আসতে হয়। ১১ বছর ধরে রাস্তায় পাশে দাঁড়িয়ে ডাব বিক্রি করে যাচ্ছেন তিনি।
গতকাল সকালে নগরের কুমারপাড়া মোড়ে লাবণীর স্বামী কমল দাসকে বেশ কিছু ছোট-বড় ডাব নিয়ে বসে থাকতে দেখা গেছে। তিনি কথা বলতে পারেন না। কোন ডাবের কত দাম, সেটাও ভালো করে বোঝেন না। লাবণী কাগজে চার ধরনের ডাবের পাশে দাম লিখে দিয়ে গেছেন। আর দামের সঙ্গে মিলিয়ে চিনিয়ে দিয়ে গেছেন ডাব। ক্রেতা যে ডাবে হাত দিচ্ছেন, কমল দাস সেই ডাবের দাম লেখা-সংবলিত কাগজের দিকে আঙুল নির্দেশ করছেন। বোঝা গেল, এভাবেই কমল দাস তাঁর স্ত্রীকে সহযোগিতা করেন।
আলাপচারিতায় লাবণী বলেন, শীতের আমেজ শুরু হওয়ার পর থেকে ডাবের ক্রেতা কমতে শুরু করেছে। কিন্তু ডাবের দাম বেড়ে গেছে। প্রতিটি ডাব এখন গড়ে ২০ টাকা বেশি দিয়ে কিনতে হচ্ছে। গরমের সময় যে ডাব ৮৮ থেকে ৯০ টাকায় কিনতেন। এখন সেই ডাব ১০০ থেকে ১১০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। কয়েক দিন আগে ১০০ ডাব কিনে ১২টিই নষ্ট পেয়েছেন। মানে ১ হাজার ২০০ টাকা নষ্ট। এরই মধ্যে সব জিনিসের দাম বেড়ে গেছে। শুধু ডাবের ওপরে সংসার টেকানো কঠিন হয়ে গেছে।
সামনের বছর লাবণীর ছেলে তন্ময় দাস এসএসসি পরীক্ষা দেবে। ছেলেকে নিয়ে লাবণীর অনেক স্বপ্ন। তাই কষ্ট করে হলেও ছেলের লেখাপড়ার খরচ চালানো অব্যাহত রেখেছেন। ছেলে তার মাকে বলে, ‘মা, তুমি আর আমি একসঙ্গে এসএসসি পরীক্ষা দেব।’ এ বিষয়ে লাবণী বলেন, ‘সারা দিন খাটুনির পর আর পড়তে বসা হয় না। আমার আর এসএসসি দেওয়া হবে না।’