ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তাব্যবস্থা ফাঁকি দিয়ে ফ্লাইটে উঠে পড়া শিশুটির শিকল খুলে দিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা। ১২ বছর বয়সী শিশুটি এখন গ্রামে নির্বিঘ্নে ঘোরাফেরা করছে। শিশুটি না বলে আর কোথাও যাবে না, এমন আশ্বাস পেয়ে শিকল খুলে দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা।
শিশুটির বাড়ি গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলায়। আজ শুক্রবার সকালে শিশুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির সামনে একটি খাল। খালের ওপরে থাকা বাঁশের সাঁকো দিয়ে বাড়ির দিকে যাচ্ছে শিশুটি। সাঁকোর ওপাড়ে টিনের ঘরের সামনে বসে আছেন শিশুটির বাবা। পাশে ছোট খড়ির বেড়ার ঘরে চলছে রান্নাবান্না।
গত সোমবার দিবাগত রাত তিনটার দিকে নিরাপত্তাবেষ্টনী পেরিয়ে কুয়েত এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইটে উঠে পড়েছিল শিশুটি। রাত সোয়া তিনটার দিকে ওই ফ্লাইট উড্ডয়নের কথা ছিল। শিশুটিকে ফ্লাইটের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কেবিন ক্রুরা তাকে তার আসনে বসতে বলেন। তার গতিবিধি সন্দেহজনক হওয়ায় কেবিন ক্রু তাকে তার মা-বাবার পাশে বসতে বলেন। তখন শিশুটি জানায়, মা-বাবা তার সঙ্গে নেই। কার সঙ্গে উড়োজাহাজে উঠেছে, সেটাও বলতে পারছিল না। এমনকি তার সঙ্গে পাসপোর্ট, টিকিট ও বোর্ডিং পাসও ছিল না।
গত বুধবার সকালে শিশুটিকে বিমানবন্দর থানা থেকে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। তবে বাড়ির সামনে ইজিবাইক থেকে নেমে চাচার ঘরে ঢুকলেও শিশুটি সেখান থেকে পালিয়ে যায়। পরে বেলা একটার দিকে এক আত্মীয়ের বাড়ি থেকে তাকে খুঁজে আনা হয়। বাড়িতে আনার পর শিশুটির পায়ে শিকল দিয়ে ঘরের খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছিল। পরে তাকে বুঝিয়ে শিকল খুলে দেওয়া হয়েছে।
শিশুটির বাবা পেশায় একজন সবজি বিক্রেতা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ২০১০ সালে প্রথম বিয়ে করেন। ২০১১ সালের ১১ অক্টোবর তাঁর ছেলের জন্ম হয়। ২০১৩ সালে তাঁর স্ত্রী তাঁদের ছেড়ে অন্যত্র চলে যান এবং দ্বিতীয় বিয়ে করেন। পরে তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করেন।
শিশুটির বাবা আরও বলেন, ‘ওর বয়স যখন ছয় বছর, তখন মাদ্রাসায় ভর্তি করে দিই। মাকে দেখার জন্য মন সব সময় ব্যাকুল থাকত। মাঝে মাঝে মাদ্রাসা থেকে পালিয়ে প্রথমেই তার মায়ের কাছে যেত। মা তাকে আশ্রয় দিত না। কষ্টে সে অন্যত্র যেত। সেখান থেকে খুঁজে নিয়ে আসতাম।’
এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে শিশুটি বলে, গত বৃহস্পতিবার (৭ সেপ্টেম্বর) সকালে মাকে খুব মনে পড়ছিল তার। দেখার জন্য বাড়ি থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে মায়ের কাছে যায়। খুব সকালে ভাত না খেয়ে বাড়ি থেকে রওনা হয়েছিল। কিন্তু পৌঁছার পর মা তাকে কাছে না ডেকে ফিরিয়ে দেয়। ওই সময় সে সিদ্ধান্ত নেয়, মায়ের কাছে আর কোনো দিন যাবে না। ওখান থেকে এক আত্মীয়ের বাড়ি হয়ে ঢাকায় চলে যায়। শিশুটি বলছিল, ‘যখন কেউ আমাকে ধমক দিয়ে কথা বলে, তখনই মায়ের কথা মনে পড়ে। মন চায় তখনই মায়ের কাছে চলে যাই। মা যখন তাড়িয়ে দিল, তখন আমার মনে হলো পৃথিবীতে আমার কিছুই নেই।’
শিশুটি আরও বলে, ‘মাদ্রাসায় যখন যেতাম, বাবার কাছে কাগজ ও কলম কেনার টাকা চাইতাম। বাবা দিতে পারতেন না। খাতা–কলমের জন্য হুজুর মারতেন। মার খাওয়ার ভয়ে মাদ্রাসা থেকেও মাঝে মাঝে পালাতাম।’
শিশুটি বড় হয়েছে তার দাদির (৫৫) কাছে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ও যখন ছোট, তখন তার মা চলে যায়। আমি তাকে অন্যের বাড়ি থেকে গরুর দুধ এনে খাইয়ে বাঁচিয়েছি। এখনো আমার কাছেই থাকে। মায়ের কথা বলে ও একা একাই মায়ের কাছে চলে যায়। বাড়িতে আমার কাছেই ঘুমায়, অনেক কথা বলে এবং কষ্টের কথা বলে। ওই কষ্ট থেকেই এমন হয়ে গেছে।’