কোটা আন্দোলনে গিয়ে গুলিতে নিহত আসিফ হাসান
কোটা আন্দোলনে গিয়ে গুলিতে নিহত আসিফ হাসান

গুলিতে নিহত আসিফের মা বললেন, ‘কার কাছে বিচার চাইব’

আসিফের বাবা এখন একরকম বাকরুদ্ধ। বসে থাকেন বাড়িতে অথবা বাড়ির পাশের মসজিদে। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন সামনের দিকে। ফিসফিস করে বললেন, ‘ওকে বাড়ি চলে আসতে বলেছিলাম। টাকা পাঠালাম। এলো, তবে জীবিত নয়, লাশ হয়ে।’ মা কান্না করে বলছেন, ‘আমার আসিফ কোনো অন্যায় করতে পারে না। ওকে কেন তোমরা মেরে ফেললে? ওকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখেছিলাম। ওকে লেখাপড়া করাতে বিদেশে পাঠাব। আমার সব স্বপ্ন শেষ হয়ে গেল।’

কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গত ১৮ জুলাই ঢাকার উত্তরায় বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে গুলিতে মারাত্মক আহত হন আসিফ হাসান। দুপুর ১২টার দিকে তাঁকে উত্তরা আধুনিক মেডিকেলে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। ঘটনার পরপরই আসিফের নিহত হওয়ার খবর বাড়িতে আসে। খবর ছড়িয়ে পড়লে আত্মীয়স্বজনসহ আশপাশের গ্রাম থেকে মানুষ বাড়িতে আসতে থাকেন।

আসিফের বাবার নাম মাহমুদ হাসান। তিনি আগে চিংড়ি চাষ ও ব্যবসা করতেন। এখন তেমন কিছু করেন না। নিরিবিলি সময় কাটান বাড়িতে। আসিফের মা শিরিন আক্তার গৃহিণী।

আসিফদের বাড়ি সাতক্ষীরা শহর থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে দেবহাটা থানার নওয়াপাড়া গ্রামের আস্কারপুর গ্রামে। এই গ্রামের সবুজে ঘেরা বিশাল বাড়িতে বড় হয়েছেন আসিফ। তিন বোন আর দুই যমজ ভাইয়ের মধ্যে আসিফ মা–বাবার চতুর্থ সন্তান। ছোটবেলা থেকে মেধাবী। পাশের নলতা হাইস্কুল থেকে এসএসসি ও নলতা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে ঢাকায় নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হন তিনি। থাকতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলে।

গতকাল শনিবার সকালে দেবহাটায় আসিফদের বাড়িতে গিয়ে তাঁর বাবা মাহমুদ হাসানকে পাওয়া যায়নি। তাঁর ছোট ভাই রাকিব হাসানকেও বাড়িতে পাওয়া গেল না। আসিফের চাচা বাদশা আলম জানান, আসিফের বাবা, ছোট ভাই ও চাচা মামুন গাজী শনিবার সকালে ঢাকায় গেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে তাঁদের সঙ্গে কথা বলবেন আজ রোববার কোনো এক সময়ে।

ঘটনার দিন ১৮ জুলাই সন্ধ্যায় আসিফদের বাড়িতে গিয়ে এক শোকাবহ পরিবেশ দেখা গিয়েছিল। বিশাল ভবনের সামনে উঠানে কয়েক শ মানুষ ছিলেন। সবাই বিষণ্ন। আসিফের বাবা মাহমুদ আলম বসে ছিলেন তাঁদের মধ্যে। কোনো কথা নেই, নিশ্চুপ। তাকিয়ে ছিলেন আকাশের দিকে। চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছিল অশ্রু। তাঁর পাশে ঘণ্টাখানেক বসে উঠে আসার সময় তিনি বলেছিলেন, ‘আমার কিছু বলার নেই।’ পরে আরেক প্রশ্নে বললেন, ‘সকাল ১০টার দিকে কথা হয় তাঁর সঙ্গে আমার। বলেছিল, “বাবা হোস্টেলে থাকতে পারছিনে। হোস্টেলে থাকলে আন্দোলনে যেতে হবে। আর আন্দোলনে গেলে পুলিশের মার খেতে হবে।” আমি টাকা পাঠিয়ে দিয়ে বলেছিলাম, বাবা বাড়ি চলে আয়। ওই শেষ কথা। তারপর আসিফ বাড়ি ফিরেছে। তবে লাশ হয়ে। ইচ্ছা ছিল ছেলেকে বিদেশে পড়াব। মানুষ করব। সব শেষ হয়ে গেল।’

আসিফের প্রতিবেশীরা জানান, আসিফের লাশের দাফন করার জন্য সময় নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৯ জুলাই  শুক্রবার বাদ জুমা। সেভাবেই প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল। ১৮ জুলাই দিবাগত রাত সাড়ে তিনটার দিকে তাঁর মরদেহ ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়িতে পৌঁছায়। কিন্তু পুলিশ-প্রশাসনের হস্তক্ষেপে শুক্রবার ফজরের নামাজের পরপরই বাড়ির পাশের ফাঁকা জায়গায় জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়। মরদেহ আসার খবর প্রতিবেশী কিংবা গ্রামের মানুষ জানার আগেই তাঁকে দাফন করতে হয়।

গতকাল শনিবার ফের আসিফদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তাঁর মা শিরিন আক্তার  কান্নাকাটি করে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। কথা বলতে পারছেন না। অনেকটা নির্বাক। বাড়ির একটি ঘরে তাঁকে ঘিরে বসে আসেন কয়েকজন নারী। কিছু বলতে চান কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কার কাছে বিচার চাইব। আমার ছেলে তো কোনো দোষ করতে পারে না। ওকে আমরা সেইভাবে মানুষ করেছি।’

দেবহাটা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আল ফেরদৌস আলফা বলেন, প্রধানমন্ত্রী নিহত আসিফের বাবা ও মায়ের সঙ্গে কথা বলার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। আসিফের বাবা, ভাই ও চাচা গতকাল সকালে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেন। তাঁদের সঙ্গে জেলা প্রশাসনের একজন ম্যাজিস্ট্রেট আছেন।