নরসিংদীর রায়পুরায় পাড়াতলী কলিম উদ্দিন উচ্চবিদ্যালয়ে ‘কবি শামসুর রাহমান স্মৃতি গ্রন্থাগার’ নির্মিত হয়েছিল ২০০৯ সালে। কবির মৃত্যুর পর তাঁর স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখতে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে গ্রন্থাগারটি নির্মাণ করে জেলা পরিষদ। তখন মন্ত্রণালয় থেকে বেশ কিছু বই ও আসবাব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ১৪ বছর ধরে গ্রন্থাগারটি তালাবদ্ধ। কয়েকটি চেয়ার-টেবিল ছাড়া বইপত্রের কোনো হদিস নেই। গ্রন্থাগারটির দেখভালের দায়িত্ব আসলে কার, সেটিও জানেন না কেউ।
বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছে, কবি শামসুর রাহমানের নামে বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে গ্রন্থাগারটি নির্মিত হলেও এর কোনো কর্তৃত্ব তাদের হাতে নেই। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় নির্মাণ করে দেওয়ার পর থেকে এর দেখভালের দায়িত্ব উপজেলা প্রশাসনের। তবে উপজেলা প্রশাসন বলছে, উপজেলায় এমন কোনো গ্রন্থাগার নেই, যা তাদের আওতাধীন। ওই গ্রন্থাগার দেখভালের দায়িত্বও তাদের নয়। দায়িত্ব এড়াতে হয়তো তারা উপজেলা প্রশাসনের নাম বলেছে।
কবি শামসুর রাহমানের পৈতৃক বাড়ি পাড়াতলী গ্রামে। সেখানে তাঁর অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের এক দুপুরে বাড়ির পুকুরপাড়ে বসে তিনি লিখেছিলেন অমর দুটি কবিতা ‘স্বাধীনতা তুমি’ ও ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’। পাঁচ বছর পর ওই পুকুরে ডুবে মারা যান কবির কিশোরপুত্র ওয়াহিদুর রাহমান। তাঁর স্মৃতিজড়ানো গ্রামে বিদ্যালয়ের ঠিক মাঝখানে গ্রন্থাগারটির অবস্থান।
গত মঙ্গলবার গ্রন্থাগারটিতে গিয়ে দেখা গেছে, একতলা ভবনের কক্ষজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে নানা আসবাব ও মালামাল। শেষ প্রান্তের দুই কোনায় দুটি স্টিলের আলমারি, কয়েকটি বইয়ের তাক ও সোফা। সামনেই ভাঙাচোরা কাঠের কিছু আসবাব একটির ওপর আরেকটি রাখা। এক পাশে কয়েকটি চেয়ার ও অব্যবহৃত টেবিল, অন্য পাশে দুটি সেলাই মেশিন ও স্টিলের তাক। ওপরে চারটি পাখা ঘুরছে, মেঝেতে দুটি তোশক পাতা। সেখানে শুয়ে মুঠোফোনে কথা বলছেন এক যুবক। যুবকের পরিচয় জানতে চাইলে কোনো উত্তর দেননি। তবে পুরো কক্ষ ঘুরে একটিও বইয়ের দেখা মেলেনি।
বিদ্যালয়টির ১০ জন সাবেক ও বর্তমান শিক্ষক প্রথম আলোকে বলেন, কোনো জনবল না থাকায় প্রতিষ্ঠার অল্প কয়েক দিন পর গ্রন্থাগারটি বন্ধ হয়ে যায়। ওই সময় আসবাবসজ্জিত গ্রন্থাগারটিতে বেশ কিছু বই ছিল। বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও স্থানীয় সচেতন ব্যক্তিরা গল্প, কবিতা ও উপন্যাস পড়তে আসতেন। কয়েক দিন পরই চিত্র বদলাতে শুরু করে। সেই থেকে এখন পর্যন্ত এটি তালাবদ্ধ। তবে কী কারণে তালাবদ্ধ করা হয়েছিল, কেউ বলতে পারেননি। তাঁরা বলেন, মাঝেমধ্যে একটি রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা সেটি ব্যবহার করেন, তখন তালা খুলে দেওয়া হয়। এ ছাড়া বিদ্যালয়ের নৈশপ্রহরী সেখানে থেকে দায়িত্ব পালন করেন।
জেলা পরিষদের সহকারী প্রকৌশলী নূর ই এলহাম বলেন, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে মোট ১৭ লাখ ৭২ হাজার টাকায় পাড়াতলীতে কবি শামসুর রাহমান স্মৃতি গ্রন্থাগারটি নির্মাণ করে জেলা পরিষদ। বাস্তবায়নকারী সংস্থা হিসেবে ২০০৯ সালেই নির্মাণকাজ শেষ করে ওই ভবন হস্তান্তর করা হয়। ভবন হস্তান্তরের এক বছরের মধ্যে কোনো সংস্কারের প্রয়োজন না পড়লে তাঁদের আর কোনো দায়িত্ব থাকে না।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, গ্রন্থাগারটিতে কোনো বইপত্র নেই। সব সময় তালাবদ্ধ থাকে। তবে গ্রন্থাগারের চাবি তাঁদের কাছে আছে। তবে সেটি পরিচালনার দায়িত্ব তাঁদের কাছে না থাকায় ভেতরে কী কী আসবাব আছে, তা-ও জানেন না। গ্রন্থাগারটি পরিচালনার দায়িত্ব আসলে কার, তা জানার চেষ্টা করছেন বলে তিনি জানান।
রায়পুরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আসগর হোসেন বলেন, কবি শামসুর রাহমানের নামে নির্মিত গ্রন্থাগারটির বর্তমান অবস্থা শুনে কষ্ট লাগছে। দীর্ঘদিন ধরে কেন সেটি তালাবদ্ধ, সে বিষয়ে বিস্তারিত খোঁজ নেওয়া হবে। বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে ব্যাখ্যাও চাওয়া হবে। এ ক্ষেত্রে তাঁদের যা করণীয়, তা করা হবে।
জানতে চাইলে কবি শামসুর রাহমানের ভাতিজা ও কেন্দ্রীয় যুবলীগের কার্যকরী সদস্য ব্যারিস্টার তৌফিক রাহমান বলেন, ২০০৯ সালে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় গ্রন্থাগারটি নির্মাণ করে দিলেও তা পরিচালনার দায়িত্ব সুনির্দিষ্টভাবে কাউকে দেওয়া হয়নি। এ ছাড়া দেখেশুনে রাখার জন্য কোনো জনবল নিয়োগ না দেওয়ায় প্রথম থেকেই নানা সমস্যা হচ্ছিল। পরে গ্রন্থাগারটি কোনো ধরনের ফান্ডও পায়নি। দ্রুততম সময়ে গ্রন্থাগারটির কার্যক্রম আবার পুরোদমে চালু করার উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে তিনি জানান।