দিনাজপুরে কালবৈশাখী ঝড়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। গাছপালা উপড়ে পড়েছে, বাড়িঘর ভেঙেছে। উপড়ে পড়েছে বৈদ্যুতিক খুঁটিও। গাছের ডাল ভেঙে মাথায় পড়ে গুরুতর আহত হয়েছেন দিনাজপুর সরকারি কলেজের এক নিরাপত্তাপ্রহরী। গতকাল বুধবার দিবাগত গভীর রাতে এই ঝড় আঘাত হানে। মাত্র পাঁচ মিনিট স্থায়ী ছিল এই ঝড়। তাতেই ফল-ফসলসহ এমন ক্ষতির মুখে পড়েছে মানুষ। এদিকে ঝড়ের পর থেকে শহর এলাকা বিদ্যুৎ–বিচ্ছিন্ন থাকায় দুর্ভোগে পড়েছেন শহরবাসী।
দিনাজপুর আঞ্চলিক আবহাওয়া কার্যালয় সূত্র জানায়, গতকাল দিবাগত রাত ১টা ৪৬ মিনিট থেকে ১টা ৫১ মিনিট পর্যন্ত স্থায়ী ছিল এই কালবৈশাখী ঝড়। ঝড়ের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৫৫ থেকে ৬০ কিলোমিটার। সঙ্গে শিলাবৃষ্টিও পড়েছে। এ সময় বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে ১২ দশমিক ২ মিলিমিটার।
আজ বৃহস্পতিবার সকালে শহরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, রাস্তায় ভেঙে পড়া গাছপালা অপসারণে ব্যস্ত ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের কর্মীরা। দিনাজপুর সরকারি কলেজ মোড় এলাকায় রাস্তার দুই পাশে গাছের ডাল ভেঙে রাস্তায় পড়েছে। কলেজ চত্বরে ২০টির বেশি গাছের ডালপালা ভেঙেছে, উপড়ে পড়েছে একটি পাকুড়গাছ।
কলেজের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী আহাদ আলী বলেন, মেয়েদের হোস্টেল ভবনের গেটে নিরাপত্তারক্ষী ছিলেন রায়হান আলী (২৮)। রাতে ঝড়ের সময় গাছের ডাল ভেঙে মাথায় পড়ে তাঁর। গুরুতর আহত অবস্থায় দিনাজপুর জিয়া হার্ট ফাউন্ডেশনে তাঁকে ভর্তি করা হয়েছে।
শহরের ঐতিহাসিক গোর-এ শহীদ বড় ময়দানে রাস্তার পাশে এবং জেলা প্রশাসন চত্বরে কয়েকটি গাছ ভেঙে পড়েছে। হকার্স মার্কেটে অর্ধশতাধিক দোকান ঘরের টিনের চাল উড়ে গেছে। পোশাক ব্যবসায়ী সবুজ সরকার বলেন, দোকান ঘরগুলোর চাল উপড়ে পড়ায় সব মালামাল ভিজে গেছে। এই ঝড়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছেন হকার্স মার্কেটের ব্যবসায়ীরা।
শহরের শেখপুরা, মেধ্যাপাড়া বস্তি এলাকায় শতাধিক ঘরবাড়ি ভেঙে পড়েছে। মধ্যরাত থেকে খোলা আকাশের নিচে রয়েছে মানুষ। মেধ্যাপাড়া এলাকার বাসিন্দা আনিসুল হক (৪৮) বলেন, ‘এমন ঝড় দেখো নাই জীবনে। মাত্র কয়েক মিনিটের মইধ্যে সব শেষ হই গেল। মনে হওছে সব উল্টায় নি যাছে। ভাইরে ভাই এছা বিদ্যুৎ চমকানি আর আকাশের ডাক আর জীবনে দেখো নাই।’
এদিকে মধ্যরাত থেকে বিদ্যুৎ না থাকায় দুর্ভোগে পড়েছে মানুষ। ইন্টারনেটের তার ছিঁড়ে পড়েছে। কয়েকটি স্থানে মুঠোফোনের নেটওয়ার্কও পাওয়া যাচ্ছে না। চার্জ দিতে না পারায় ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক চলাচলও কমেছে। ইজিবাইকের চালক বাবুল আক্তার বলেন, ‘সারা দিন গাড়ি চালায় রাতে চার্জ দিই। বিদ্যুৎ না থাকায় গাড়ি চার্জ দিতে পারি নাই। তিনি বলেন বিদ্যুৎবিহীন আর চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা থাকলে শহরে ৭০ শতাংশ ইজিবাইক চলাচল কমে যাবে।’
এই ঝড়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে লিচু ও আমচাষিরা। সদর উপজেলার মাসিমপুর ও বিরল উপজেলায় ফল ধরা গাছের ডাল ভেঙে পড়েছে। লিচু ব্যবসায়ী মোসাদ্দেক আলী বলেন, এমনিতেই এবার তীব্র তাপপ্রবাহে লিচুর ক্ষতি বেশি হয়েছে। তার ওপর এমন কালবৈশাখী ঝড়ে আরেক দফা ক্ষতির মুখে পড়ল চাষি ও ব্যবসায়ীরা।
দিনাজপুর জেলা প্রশাসক শাকিল আহমেদ বলেন, আচমকা ঝড়ের কারণে দিনাজপুর শহরসহ বেশ কয়েকটি উপজেলায় গাছপালা কাঁচা ঘরবাড়ি ও উঠতি ফসলের বেশ কিছু ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সংশ্লিষ্ট বিভাগ সেসবের তথ্য সংগ্রহে কাজ করছে।
কালবৈশাখী ঝড়ে ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে দিনাজপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা জাফর ইকবাল জানান, প্রাথমিকভাবে মাঠপর্যায়ে কর্মকর্তারা জরিপ করেছেন। ঝড়ে মোট ২৭০ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে আম ১০২ হেক্টর, লিচু ১৩৬ হেক্টর, কলা ২০ হেক্টর, ভুট্টা ৭ হেক্টর।
নীলফামারীর সৈয়দপুরে আকস্মিক কালবৈশাখী ঝড়ে গাছপালা ও বাড়িঘরের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বিভিন্ন এলাকা বিদ্যুৎ–বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। শহরের মধ্যে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে সাহেবপাড়া, বাঁশবাড়ি আমিন মোড় এলাকায়। ওই এলাকায় শতবর্ষী একটি গাছ ঝড়ে উপড়ে পড়ে আশপাশের বেশ কয়েকটি দোকান, হোটেল ও বাড়িঘরের ব্যাপক ক্ষতি করে। এ ছাড়া আকস্মিক এই ঝড়ে উপজেলার কামারপুকুর, বাঙালিপুর, খাতামধুপুর, কাশিরাম বেলপুকুর ও বোতলাগাড়ি ইউনিয়নে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
সৈয়দপুর আবহাওয়া কার্যালয়ের দেওয়া তথ্যমতে, গতকাল দিবাগত রাত ১টা ৪৫ মিনিট থেকে ২টা পর্যন্ত স্থায়ী ওই কালবৈশাখী ঝড়ের গতিবেগ ছিল ৫০ থেকে ৬০ কিলোমিটার।
সৈয়দপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নূর ই আলম সিদ্দিক বলেন, ‘আকস্মিক ঝড়ের কারণে সৈয়দপুর উপজেলার বিভিন্ন পাড়ামহল্লায় গাছপালা, কাঁচা ঘরবাড়ি, দোকানপাট ও উঠতি ফসলের বেশ ক্ষতি হয়েছে। কোনো প্রাণহানি হয়নি। আমরা ক্ষতি নিরূপণের চেষ্টা করছি।’