ছয় বছর তিন মাস আগে একটি অস্ত্র মামলায় গ্রেপ্তার হন নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার মর্দাসাদী গ্রামের বাসিন্দা শের আলী (৩৩)। জমি বিক্রির টাকায় জামিন নিয়ে গত বৃহস্পতিবার জেল থেকে বের হন। এর তিন দিন পর গত রোববার দিবাগত রাতে সোনারগাঁর বাঘরী বিলে ডাকাত সন্দেহে গ্রামবাসীর পিটুনিতে শের আলীসহ চারজনের মৃত্যু হয়।
শের আলী অস্ত্র, ডাকাতিসহ অন্তত আটটি মামলার আসামি ছিলেন বলে জানিয়েছে পুলিশ। গণপিটুনিতে নিহত বাকি তিনজনের পরিচয় পাওয়া গেলেও শের আলীর পরিচয় পাওয়া যাচ্ছিল না। আজ মঙ্গলবার দুপুরে নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের মর্গে নিহত ব্যক্তিদের লাশ নিতে আসা স্বজনেরা শের আলীর লাশও শনাক্ত করেন। পরে তাঁদের কাছ থেকে মুঠোফোন নম্বর নিয়ে যোগাযোগ করা হলে স্বজনেরা শের আলীর পরিচয় নিশ্চিত করেন।
মুঠোফোনে নিজেকে শের আলীর ভাতিজা পরিচয় দেওয়া জুয়েল রানা নামের এক যুবক প্রথম আলোকে বলেন, শের আলীর মা–বাবা কেউ বেঁচে নেই। দুটি বিয়ে করলেও তাঁর স্ত্রীদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ ছিল না। ১২ বছর বয়সী একমাত্র মেয়ে নানার বাড়িতে থাকেন। স্বজন বলতে শের আলীর দুই ভাই ও দুই বোন। জুয়েল জানান, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে সোমবারই তাঁরা শের আলীর ছবি দেখেন। তারপর লাশ নেওয়ার কথাও ভেবেছেন। তবে গ্রামবাসীর আপত্তিতে তাঁরা লাশ নেওয়ার সাহস করেননি।
ভাই আমার হাজার অপরাধী হোক। দেশে তো আইন–আদালত আছে, বিচার আছে। এমনে এতগুলা মানুষরে খুন করা হইল। আমি আমার ভাই হত্যার বিচার চাই।নাজমা বেগম, গণপিটুনিতে নিহত নবী হোসেনের বোন
লাশ নিতে গ্রামবাসী বাধা দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে জুয়েল রানা বলেন, ‘ওনার কারণে বারবার গ্রামের বদনাম হইসে। এই কারণেই গ্রামবাসী লাশ নিতে বাধা দিতেছে।’ জুয়েল বলেন, শের আলী জীবনে প্রথমবার তিন বছর জেল খাটেন। জেল থেকে বের হওয়ার তিন মাস পর আবার আরেক মামলায় পাঁচ বছর সাজা হয়। এক মাস পর আরেক অস্ত্র মামলায় ছয় বছর তিন মাস জেল খাটেন। কথা দিয়েছিলেন এবার জেল থেকে বের হয়ে ভালো হয়ে যাবেন। সে কারণে স্বজনেরা তাঁর মালিকানার জমি বিক্রি করে জামিনের ব্যবস্থা করেন। বৃহস্পতিবার তিনি বাড়িতে আসেন। রোববার সকালে পাশের গ্রামে মেয়ের সঙ্গে দেখা করার কথা বলে বের হন। বিকেল থেকে তাঁর মুঠোফোন নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়।
আজ সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত শের আলীর লাশ নারায়ণগঞ্জ ১০০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের মর্গে দেখা গেছে। পুলিশ জানিয়েছে, তাঁর লাশে পচন ধরেছে। রাত পর্যন্ত তাঁর লাশ কেউ না নিলে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হবে বলে জানিয়েছেন সোনারগাঁ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এস এম কামরুজ্জামান।
গণপিটুনিতে নিহত চারজনের মধ্যে বাকি তিনজনের লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে, নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের মর্গে তিনজনের ময়নাতদন্ত শেষে মঙ্গলবার বিকেলে নবী হোসেন ও আবদুর রহিমের লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এ ছাড়া ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ময়নাতদন্তের পর জাকির হোসেনের লাশ স্বজনদের বুঝিয়ে দেওয়া হয়।
আবদুর রহিমের ছোট ভাই আবদুর রহমান বলেন, আড়াইহাজারের কালাপাহাড়িয়ায় থাকতে দিনমজুরির কাজ করতেন রহিম। প্রায় ১৫ বছর ধরে স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুরে চলে আসেন। সেখানে তিনি রাজমিস্ত্রির সহযোগীর কাজ করতেন।
লাশ নিতে এসে ভাই হত্যার বিচার দাবি করেন নবী হোসেনের বোন নাজমা বেগম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভাই আমার হাজার অপরাধী হোক। দেশে তো আইন–আদালত আছে, বিচার আছে। এমনে এতগুলা মানুষরে খুন করা হইল। আমি আমার ভাই হত্যার বিচার চাই।’ মর্গের সামনে বসে নাজমা বলেন, নবী ১০ হাজার টাকা বেতনে স্থানীয় একটি কারখানায় কাজ করতেন। তাঁর নয় মাস বয়সী একটি সন্তান রয়েছে। স্ত্রী ৮ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। স্বামীর মৃত্যুর খবরে স্ত্রী বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন। তাই তিনিই এসেছেন ভাইয়ের লাশ নিতে।
এদিকে গণপিটুনির ঘটনায় গ্রামবাসীর বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা হয়েছে। পুলিশ বাদী হয়ে আজ বিকেলে সোনারগাঁ থানায় মামলাটি করে। মামলায় কারও নাম কিংবা আসামির সংখ্যা উল্লেখ করা হয়নি। সোনারগাঁয়ের ওসি এস এম কামরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘কেউ অপরাধী হলেও গণপিটুনি দিয়ে হত্যা অপরাধ। আমরা তদন্ত করে দোষীদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসব।’