ভাবনাটা অনেক দিন ধরেই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। কিন্তু পকেটে ছিল না টাকা। হতোদ্যম হননি মোটেও। কৃষিপণ্য উৎপাদন ও ব্যবসা করতে বিনিয়োগকারী নিয়ে এসেছেন। নিজের বুদ্ধি-শ্রম আর অন্যের টাকা বিনিয়োগ করে মাত্র কয়েক বছরের মাথায় তিনি এখন সফল উদ্যোক্তা। গরুর খামার, ফলের বাগান, কুঁড়েঘর—সব মিলিয়ে তাঁর কয়েক কোটি টাকার প্রকল্প।
বলছিলাম মুজাহিদুল ইসলামের (৩৮) কথা। শূন্য হাতে কৃষি খামারের সূচনা করেছিলেন নওগাঁর পোরশা উপজেলায় সীমান্তঘেঁষা নোনাহার গ্রামে। ইজারা নেওয়া ৬৭ একর জমির ওপর মুজাহিদের বিশাল খামার। নাম ‘ফ্রেশি ফার্ম’। সবার কাছে তিনি জাহিদ নামে পরিচিত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাণিবিদ্যা বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন। পড়ার পাশাপাশি বিপণনকর্মী হিসেবে চাকরিও নিয়েছিলেন একটি প্রতিষ্ঠানে। কাজের চাপে পড়াটা আর এগোয়নি। ছিটকে পড়েন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। সেই ২০০৫ সালের কথা। চাকরিতেও ইস্তফা দেন। আঁকড়ে ধরেন ফ্রিল্যান্সিং। নিজের চেষ্টায় গুগল করে করে শিখেন গ্রাফিক ডিজাইন ও ওয়েব ডেভেলপিংয়ের কাজ। একসময় ফ্রিল্যান্সিং থেকে টাকা আসতে লাগল। স্বপ্ন বুনতে লাগলেন। শেষমেশ কৃষিপণ্য উৎপাদন, গরুর খামার করার ভাবনাটা তাঁর মনে ধরে। কিন্তু টাকা কোথায়!
পুঁজি সংগ্রহের জন্য ইন্টারনেটে ক্রাউডফান্ডিং প্ল্যাটফর্মের দ্বারস্থ হলেন। সেখানে নিজের ভাবনার কথা কিছু মানুষকে বললেন। অনেকের মনে ধরল সেই পরিকল্পনা। বাস্তবায়নে পুঁজি নিয়ে এগিয়ে এলেন কেউ কেউ। এভাবে ক্রাউডফান্ডিং বা গণ–অর্থায়নের মাধ্যমে পুঁজি জোগাড় হলো।
খামারের আয়-ব্যয়, গরু-ছাগলের হিসাব, কোন বাগানে কয়টা গাছ, কত টাকার বেচাকেনা হচ্ছে—সবই তিনি ওয়েবসাইটে (https://www.freshie.farm/) প্রকাশ করেন। তথ্য পাওয়ার পাশাপাশি কেউ বিনিয়োগ করতে চাইলেও সব এই ওয়েবসাইটেই পাওয়া যাবে।
ক্রাউডফান্ডিংয়ের মাধ্যমে কৃষি খামার গড়ে তোলার এমন নজির দেশে আরও দুটি আছে উল্লেখ করে তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক প্রতিষ্ঠান ‘দ্রুত লোন’–এর সভাপতি শওকত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, এটি মূলত বিশ্বাসের ওপর নির্ভর করে। কেউ যদি অঙ্গীকার ঠিক রাখেন, তাহলে তহবিল পেতে সমস্যা হবে না।
মুজাহিদ তাঁর মিশ্র ফলবাগান উদ্যোগটির নাম দিয়েছেন ‘প্রজেক্ট গ্রিনিফাই’। এই প্রকল্পে জাহিদের নিজের কিছু পুঁজিসহ ৬৭ বিঘায় (৩৩ শতাংশে বিঘা) বর্তমানে ২৬ জন অংশীদারের মোট ৪৫ লাখ টাকা বিনিয়োগ রয়েছে। ২০২১ সালে এই প্রকল্পের জন্য ১৪ বিঘা জমি ইজারা নিয়ে আমের বাগান গড়ে তোলেন মুজাহিদ। আমের পাশাপাশি ড্রাগন, ফিলিপাইন ব্ল্যাক সুগার জাতের আখ ও কফিবাগানও আছে।
২০২২ সালের নভেম্বর থেকে শুরু হয় প্রজেক্ট বর্গা বা গরুর খামার প্রকল্প। বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে ১৪ লাখ টাকা নিয়ে শুরু হয় প্রকল্পটি। গত ৯ মাসে তিনটি ব্যাচে ১৮২টি গরু লালন–পালন করে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে সাড়ে ৭ লাখ টাকার বেশি আয় হয়েছে। লাভের টাকা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে সমানুপাতিক হারে ভাগ করা হয়েছে। প্রজেক্ট বর্গার তৃতীয় ব্যাচে বিনিয়োগকারী ছিলেন ১১৯ জন। এই প্রকল্পে মুজাহিদের নিজের বিনিয়োগ ১৩ লাখ, আর গ্রিনিফাই প্রজেক্টে ছিল ৭ লাখ টাকা।
বর্তমানে প্রকল্প দুটিতে বিনিয়োগ করা মূলধনের পরিমাণ প্রায় সাড়ে ৩ কোটি টাকা বলে জানালেন মুজাহিদ। নওগাঁয় খামার করলেও বাড়ি তাঁর বগুড়ার শাজাহানপুরে, দুরুলিয়া গ্রামে। সম্প্রতি একটি প্রতিষ্ঠান থেকে আফ্রিকার দেশ তানজানিয়ায় এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রস্তাব পাওয়ার কথা জানালেন মুজাহিদ। এই সাফল্যের জন্য গত বছর ‘আইপিডিসি উদ্যোক্তা সম্মাননা’ অনুষ্ঠানে নবীন উদ্যোক্তা স্মারক-২০২১-এ ভূষিত হয়েছেন মুজাহিদ।
ক্রাউডফান্ডিং মডেল সম্পর্কে মুজাহিদ বলেন, ক্রাউডফান্ডিং পদ্ধতিতে বিনিয়োগকারীকে কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানের মালিকানার অংশীদার করে নেওয়া হয়। প্রকল্পের নির্দিষ্ট মেয়াদে বিনিয়োগকারী তাঁর শেয়ার অনুযায়ী আর্থিক রিটার্ন পান ও মুনাফা-লোকসানের অংশীদার হন। প্রকল্পের প্রতিটি শেয়ারে যে পরিমাণ লাভ হয়, তার অর্ধেক টাকা পান বিনিয়োগকারী এবং অর্ধেক টাকা পায় প্রকল্প দেখভালকারী প্রতিষ্ঠান। শহরে কিংবা দেশের বাইরে থেকে যাঁদের পক্ষে বাণিজ্যিক ফলের বাগান কিংবা গরুর খামার করা সম্ভব নয়, সেই কাজটি ক্রাউডফান্ডিংয়ের মাধ্যমে ফ্রেশি ফার্ম প্রতিষ্ঠান করে দিচ্ছে।
ঢাকায় বসবাসরত সরকারি কর্মকর্তা কৌশিক আহমেদ সম্প্রতি প্রজেক্ট বর্গায় বিনিয়োগ করেছেন। তিনি বলেন, ‘জাহিদ (মুজাহিদুল ইসলাম) ভাইয়ের সাথে আমার তেমন পরিচয় ছিল না। আমার কয়েকজন সহকর্মী তাঁর প্রকল্পে বিনিয়োগ করেছেন এবং লভ্যাংশও পেয়েছেন। ওঁরা নওগাঁয় গিয়ে খামারও দেখে এসেছেন। ওঁদের কাছ থেকে গল্প শুনে এবং প্রতিষ্ঠানটির প্রতি ওঁদের বিশ্বাস ও আস্থা দেখে আমিও প্রজেক্ট বর্গার চতুর্থ ব্যাচে কিছু টাকা বিনিয়োগ করেছি।’
ঢাকার একটি প্রতিষ্ঠানে তথ্যপ্রযুক্তি কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেন শহিদুল ইসলাম। প্রজেক্ট গ্রিনিফাই ও প্রজেক্ট বর্গায় শুরু থেকেই তাঁর বিনিয়োগ রয়েছে।
প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখতে দূরদূরান্ত থেকে বিনিয়োগকারী কিংবা পর্যটকেরা নোনাহার গ্রামে আসেন। তাঁদের থাকা–খাওয়ার জন্য ফ্রেশি ফার্ম প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে গ্রামেই আটটি মাটির ঘর তৈরি করা হয়েছে। আবাসন এই প্রকল্পের নাম দেওয়া হয়েছে ‘কুঁড়েঘর ম্যাঙ্গো রিসোর্ট’। বাঁশের বেড়ার ওপর মাটির প্রলেপ দিয়ে কুঁড়েঘরগুলোর দেয়াল তৈরি করা হয়েছে। আর খড় ও বাঁশ দিয়ে তৈরি হয়েছে ছাউনি। এক শয্যার ঘরে ১০০ টাকা এবং দুই শয্যার ঘরে ২০০ টাকা ভাড়া দিয়ে দর্শনার্থীরা এখানে থাকতে পারেন।
নোনাহার গ্রামটি পড়েছে ছাওড় ইউনিয়নে। মুজাহিদের খামার সম্পর্কে ছাওড় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমানের কাছে জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘দূরদূরান্ত থেকে লোকজন এখানে এসে থাকেন। আমবাগানসহ বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখেন।’
গুগল ম্যাপের বাতলে দেওয়া পথে নওগাঁ শহর থেকে মহাদেবপুর উপজেলা সদর, নিয়ামতপুর উপজেলার ছাতড়া ও শিবপুর হয়ে পোরশার নোনাহার গ্রামের দূরত্ব ৭৫ কিলোমিটার। গত ৩০ জুলাই দুপুরে নোনাহার হাসপাতালপাড়ায় অবস্থিত প্রজেক্ট বর্গার গরুর খামারে পৌঁছান এই প্রতিনিধি। গ্রামের ভেতর দিয়ে যাওয়া পাকা সড়ক ঘেঁষে সাত বিঘা (প্রতি বিঘায় ৩৩ শতক) জমিজুড়ে খামারটি। সেখানে ২৬টি শেড থাকলেও ৪টি শেডে গরু রাখা হয়েছে।
পশ্চিমে নোনাহার গ্রামের সারকডাঙ্গা মাঠে গ্রামীণ কাঁচা সড়কের পাশেই কুঁড়েঘর ম্যাঙ্গো রিসোর্ট। রিসোর্ট থেকে মাটির পথ ধরে আরও পশ্চিমে ৫০০ মিটার দূরে ফলের বাগান। বাগানটিতে আম ও ড্রাগন ফলের গাছই বেশি। আম ও ড্রাগন ছাড়াও সেখানে আখ, কফি ও নীল অপরাজিতার খেত রয়েছে।
স্থানীয় লোকজনই এসব খামার ও প্রকল্পের দেখভাল করেন। এঁদের একজন নোনাহার গ্রামের আবদুর রশিদ (৫০)। গরুর খামারে কাজ করেন। আবদুর রশিদ বলেন, ‘মাসিক ৮ হাজার টাকা বেতনে খামার প্রতিষ্ঠার সময় থেকে আমি এখানে কাজ করছি।’
মুজাহিদের খামারটি অনেকের জন্য অনুকরণীয় বলে মন্তব্য করলেন পোরশা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মেহেদী হাসান। বললেন, যে মডেলে মুজাহিদ তাঁর কৃষি খামারটি দাঁড় করিয়েছেন, সেটা প্রশংসনীয় এবং সম্ভাবনাময়।
খামারের আরও ছবি দেখুন এখানে।