ষাটোর্ধ্ব মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর দীর্ঘদিন ধরে শ্বাসকষ্টে ভুগছেন। পিঠে ছোট আকারের বেশ কয়েকটি টিউমার, কাশিও আছে। এ জন্য প্রতিদিন ১৪০ টাকার ওষুধ কিনতে হয়। তিন চাকার গাড়িতে অলিগলি ঘুরে ঘুরে তিনি আইসক্রিম বিক্রি করেন। যা আয় হয়, তা দিয়ে সংসার চালান, কেনেন ওষুধও।
তবে গত এক সপ্তাহ আইসক্রিম নিয়ে বের হতে পারেননি জাহাঙ্গীর। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সরকার ১৯ জুলাই রাত থেকে সারা দেশে কারফিউ জারি করেছে। সারা দেশের মতো চট্টগ্রামেও কারফিউ জারি করা হলে শহর একরকম ফাঁকা হয়ে যায়। সব কাজকর্ম বন্ধ হয়ে যায়। যদিও কয়েক দিন ধরে কারফিউ শিথিল করা হয়েছে। তবু বিক্রিবাট্টা নিয়ে বেকায়দায় আছেন আইসক্রিম বিক্রেতা মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর।
আজ শনিবার সকাল ১০টায় মোহাম্মদ জাহাঙ্গীরের সঙ্গে দেখা হয়। নগরের মাইজপাড়া সড়কের একটি চায়ের দোকানে বসে তিনি ইনহেলারের ওষুধ নিচ্ছিলেন। সাধারণত বিভিন্ন শ্বাসজনিত রোগের চিকিৎসায় ইনহেলারের প্রয়োজন হয়। ইনহেলারটি দেখিয়ে জাহাঙ্গীর বলেন, প্রতিদিন বেশ কয়েকবার এটি টানতে হয়। সেটিতে মুখ লাগিয়ে একটা টান দিয়ে বললেন, ‘আর পারি না। একটা ইনহেলার এক মাসও যায় না। সংসার চলেই না।’ গোলাপি রঙের পুরোনো ছেঁড়া শার্ট পরে ছিলেন জাহাঙ্গীর। নগরের এ কে খান এলাকায় ভাড়া বাসায় তাঁদের বসবাস। পরিবারের স্ত্রী ও দুই মেয়ে। এক মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন আগেই। বাকিরা ঘরে থাকেন। ঘরভাড়া দিতে হয় সাত হাজার টাকা। আইসক্রিম বেচে প্রতিদিন পাঁচ শ থেকে এক হাজার টাকা আয় হতো। কিন্তু গত কয়েক দিন বিক্রিবাট্টা একেবারেই হয়নি। এর মধ্যে গতকাল শুক্রবার দু শ টাকা লোকসান হয়েছে।
মোহাম্মদ জাহাঙ্গীরের বাসা এ কে খান এলাকায় হলেও ২ নম্বর গেটের পাশের মাইজপাড়ায় এসে আইসক্রিম নিয়ে যান। তারপর অলিগলি ঘুরে বিক্রি করেন। এই বিক্রেতা বলেন, ‘একটানা গাড়ি চালিয়ে কোমর ধরে যায়। তাই ঘণ্টাখানিক পরপর বিশ্রাম নিতে হয়। এভাবে সারা দিনই রাস্তায় থাকতে হয়। এখন নাশতা খাওয়ার পয়সাও নেই। আবার গত কয়েক দিন বের হতে না পারায় আয়ের চাকা ঘোরেনি। বাসায় বাজারও করতে পারিনি।’
জাহাঙ্গীরের মতো বিভিন্ন পেশার মানুষ এখন কষ্টে দিন পার করছেন। চলমান সংকটের কারণে তাঁরা সবাই বিপাকে আছেন বলে জানিয়েছেন। এমনই এক ভ্যানচালক আবদুর রশীদ। তিনি বিভিন্ন বিপণিবিতান ও বাজারের মালপত্র, বাজারসদাই ভ্যানে করে আনা-নেওয়া করেন। ষোলশহর এলাকায় ভ্যান নিয়ে বসে ছিলেন তিনি। পরিচয় দিয়ে আলাপ জুড়ে দিলে তিনিও অনটনের গল্প শোনান। বলেন, সকালে পান্তা খেয়ে বের হয়েছেন। ঘরে বাজারসদাই নেই। গত এক সপ্তাহে গতকালই শুধু এক শ টাকা আয় হয়েছে। কারণ, বিপণিবিতানে ক্রেতা ছিল না। এই এক শ টাকায় ডাল ও আলু কিনে নিয়ে যাবেন। আবদুর রশীদের ভাষ্য, সংঘর্ষ শুরু হওয়ার পর থেকে বাসায় শুধু ডাল-ভাত খেতে হয়েছে। কোনো বাজার হয়নি। খুব কষ্টে দিন কেটেছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে অবশ্য এই কষ্ট কিছুটা লাঘব হবে।
আগ্রাবাদ ডেবারপাড় এলাকার বাসিন্দা দুলাল মিঞা (৫২) পেশায় রাজমিস্ত্রি। তাঁর পরিবারে পাঁচ মেয়ে ও এক ছেলে। তিন মেয়ের বিয়ে হয়েছে। বাকি দুজন দুলালের সঙ্গেই থাকেন। ছেলেও মাছের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তবে দুলাল মিঞাকেই সংসার সামলাতে হয়। গতকাল চিটাগাং শপিং কমপ্লেক্সের সামনে দাঁড়িয়ে দুলাল মিঞা প্রথম আলোকে বলেন, আট দিন পর গতকাল তিনি কাজ পেয়েছেন। সাত শ টাকা আয় হয়েছে। এ টাকা দিয়ে বাজারসদাই কিনবেন ও ধার পরিশোধ করবেন। কারণ, আট দিনে ধার করে খরচ চালাতে হয়েছে।
অন্যদিকে বগারবিলের বাসিন্দা মোহাম্মদ হোসেনের অবস্থাও ভিন্ন নয়। শাক বিক্রেতা হোসেন গত আট দিন ধরেই ক্রেতা পাননি। কারফিউর কারণে শুরুতে বাসা থেকেই বের হননি। শিথিল হওয়ার পর গত দুদিন শাক নিয়ে বের হলেও ক্রেতা হাতে গোনা। হোসেন আফসোস নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর একার আয়ে সংসার চলে। কিন্তু গত সাত-আট দিন ধারকর্জ করে চলেছেন।