অক্সিজেন-হাটহাজারী সড়কের আমানবাজার থেকে দেড় কিলোমিটার পূর্বে খন্দকিয়া গ্রাম। এই গ্রাম এখন স্তব্ধ। এলাকার লোকজন কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না ১১ তরুণের চিরতরে হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা। নিহতের স্বজনদের সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষাও খুঁজে পাচ্ছেন না তাঁরা। সবার চোখেমুখে শোকের ছায়া।
শুক্রবার দুপুরে মিরসরাই বড়তাকিয়া এলাকায় ট্রেনের ধাক্কায় মাইক্রোবাসের ১১ আরোহী নিহত হন। গুরুতর আহত হন অন্তত পাঁচজন। হতাহত সবাই আর অ্যান্ড জে কোচিং সেন্টারে ছাত্র-শিক্ষক। তাঁদের সবার বাড়ি খন্দকিয়া গ্রামে। তাঁরা মিরসরাইয়ে ঝরনা দেখতে যাচ্ছিলেন।
স্থানীয় বাসিন্দা ডা. মোহাম্মদ ইউসুফ মিঞা প্রথম আলোকে বলেন, ‘নিহত সবাই স্কুল-কলেজের ছাত্র। পাশাপাশি তারা গ্রামে কোচিং সেন্টার চালায়। এলাকার মেধাবী এতগুলো ছেলে একসঙ্গে চলে যাওয়া মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। এই শূন্যতা কীভাবে পূরণ হবে বুঝতে পারছি না।’
বিকেলে খন্দকিয়া গ্রামের যুগীর হাট এলাকায় ঢুকতেই দেখা যায়, রাস্তায় ২০০ থেকে ৩০০ মানুষ, কেউ একা দাঁড়িয়ে, কেউবা জটলা করে নিজেদের মধ্যে কথা বলছেন। সবাই বিষাদগ্রস্ত। এখানে বাজারের পাশে কোচিং সেন্টারটি অবস্থিত। এলাকার আশপাশের শিক্ষার্থীরা সেখানে কোচিং করে। দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে কোচিং সেন্টারের চারজন শিক্ষক রয়েছেন।
যুগীর হাট বাজারে আবদুর রহিম নামের এক ব্যক্তি বলেন, দুর্ঘটনাটির কথা শোনার পর থেকে তিনি কান্না ধরতে রাখতে পারছেন না। রহিমের মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে রিকশাচালক মোজাম্মেল হোসেন বলেন, ‘আমি শোনার পর চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। সবাই এলাকার ছেলে। তাদের পরিবারের কী হবে। মা-বাবা কীভাবে নিজেদের সান্ত্বনা দেবে।’
যুগীর হাট বাজার থেকে প্রায় ৫০০ মিটার উত্তরে সাবরেজিস্ট্রারের বাড়ি। এর শেষ প্রান্তে মাইক্রোবাসচালক গোলাম মোস্তফা নিরুর (২৬) বাড়ি। বাড়ির ভেতর ঢোকার মুখে রাস্তার ওপর দাঁড়ানো শতাধিক মানুষ। বাড়ি থেকে ভেসে আসে কান্নার শব্দ। ঘরের ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, গোলাম মোস্তফার স্ত্রী রুপা আক্তার বুক ফেটে কাঁদছেন। তাঁকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন ১০ থেকে ১৫ জন নারী। একজন বলেন, পাঁচ বছর আগে বিয়ে হয় গোলাম মোস্তফার। তাঁদের রুহি আক্তার নামের একটি কন্যাসন্তান রয়েছে।
মোস্তফার বাবা মো. ইউসুফ বলেন, রুহি কাকে বাবা ডাকবে?
সেখানে ১০ মিনিট অবস্থান করতে না করতে বাড়তে থাকে মানুষের ভিড়। প্রতিবেশী মিনু আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিবেশীদের সঙ্গে মোস্তফার ভালো সম্পর্ক ছিল। এখন তাঁর পরিবারের কী হবে।
মোস্তফার বাড়ি থেকে প্রায় এক হাজার মিটার দক্ষিণে কলেজছাত্র জিয়াউল হকের বাড়ি। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, ঘরের মেঝেতে বসে বিলাপ করছেন তাঁর মা শাহনাজ আক্তার। বলছেন, ছেলেকে তাঁর বুকে ফিরিয়ে দিতে। সেই বাড়ির সামনেও ভিড়। কেউ আসছেন পরিবারটিকে সান্ত্বনা দিতে, আর কেউ আসছেন হতাহতদের খবরাখবর নিতে।
জিয়াউল হকের ঘরে সামনে সড়কের বিপরীত দিকে ইকবাল হোসেনের নানাবাড়ি। তার গ্রামের বাড়ি হাটহাজারীর মাদাশায় হলেও ছোটবেলা থেকে মায়ের সঙ্গে এখানেই থাকে সে। স্থানীয় কেএস নজুমিয়া উচ্চবিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র ছিল সে। ইকবালের নানাবাড়ির সামনেও লোকজনের ভিড়।
ইকবালের নানাবাড়ি থেকে এক কিলোমিটার দক্ষিণে নিহত ওয়াহিদুল আলমের বাড়ি। তাঁর বাড়ি যাওয়ার পথে কিছুদূর পরপর লোকজনের ভিড়। সবার মুখে একই প্রশ্ন, কীভাবে ঘটনাটি হলো। নিহত কতজন। আহতেরা কেমন আছেন। ওয়াহিদুলের ঘরে ঢুকতেই তাঁর বাবা জানে আলম প্রশ্ন করেন, ‘আমার ছেলে কই। তাকে আনছে না কেন।’ এরপর তাঁকে পরিবারের সদস্যরা সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেন। ওয়াহিদুল চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজ থেকে ব্যবস্থাপনায় স্নাতক সম্মান পাস করেন। পাশাপাশি ওই কোচিং সেন্টারে শিক্ষকতা করতেন। তাঁর বোন জেসি আক্তারও কলেজছাত্রী। তিনিও সেখানে পড়ান।
জেসি আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের কোচিং সেন্টারে ছয়জন শিক্ষক রয়েছেন। চারজন শিক্ষক মিরসরাইতে বেড়াতে যান ছাত্রদের সঙ্গে। তিনিসহ আরেকজন শিক্ষক যাননি।
স্থানীয় চিকনদণ্ডী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হাসানুজ্জামান বাচ্চুকে বিকেলে দেখা গেছে নিহত ওয়াহিদুলের ঘরের সামনে। তিনি সেখানে লোকজনকে ধৈর্য ধরার অনুরোধ করেন।
স্থানীয় কেএস নজু মিয়া উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শফিউল মো. শফিউল আলম স্কুলের সামনে প্রথম আলোকে বলেন, নিহতের বেশির ভাগই তাঁর স্কুলের বর্তমান ও প্রাক্তন ছাত্র। এতগুলো মেধাবী ছেলেকে একসঙ্গে হারানোর শোক কীভাবে কাটিয়ে উঠবেন, তিনি বুঝতে পারছেন না।