জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবসহিষ্ণু ধান, ভুট্টা ও টমেটোর নতুন জাত উদ্ভাবনে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বাকৃবি) প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে অত্যাধুনিক গ্রিনহাউস। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ‘কৃষি আবহাওয়া তথ্যপদ্ধতি উন্নতকরণ’ প্রকল্পের আওতায় এবং বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ২০২১ সালের ১৯ আগস্ট এই অত্যাধুনিক গ্রিনহাউস প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু হয়।
এতে নেতৃত্ব দেন বাকৃবির অ্যাগ্রোমেটিওরোলজি বিভাগের সদ্য সাবেক বিভাগীয় প্রধান ও অন্যতম গবেষক অধ্যাপক এ বি এম আরিফ হাসান খান। গত বছর থেকে অ্যাগ্রোমেটিওরোলজি বিভাগের স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা কাজ শুরু করেন। প্রকল্পটির মেয়াদ এ বছরের নভেম্বরে শেষ হবে।
গ্রিনহাউস মূলত একটি ঘর, যেখানে প্রাকৃতিক বিভিন্ন উপাদান যেমন তাপ, তাপমাত্রা, আলোর দৈর্ঘ্য, পানি, লবণাক্ততা, আর্দ্রতা ইত্যাদির মাত্রা নিয়ন্ত্রিত রেখে বিভিন্ন ফসলের ওপর ওই উপাদানগুলোর প্রভাব বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা করা হয়। এর ফলে যেকোনো ফসলের বছরব্যাপী উৎপাদন অব্যাহত রাখা যায়। বাকৃবিতে গবেষণার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত এই অত্যাধুনিক গ্রিনহাউসে আছে আটটি সাধারণ কক্ষ, একটি নিম্ন তাপামাত্রার কক্ষ ও একটি উচ্চ তাপমাত্রার কক্ষ।
এ ছাড়া একটি কেন্দ্রীয় কক্ষ আছে, যেখানে বিভিন্ন কক্ষে রোপণ করা প্রতিটি চারার পানির পরিমাণ, বিভিন্ন সারের পরিমাণ, পানি ও সার প্রয়োগের সঠিক সময়সহ অন্যান্য বিষয় নিয়ন্ত্রণ করা হয়। মূলত কাজটি করা হয় তুরস্ক থেকে নিয়ে আসা সেন্সর–নির্ভর ‘এনআরআই ক্রপ টেকনোলজি’ যন্ত্রের মাধ্যমে। যন্ত্রটি প্রয়োজন অনুযায়ী প্রতিটি চারায় পুষ্টি উপাদান সরবরাহ করে। যন্ত্রটির মাধ্যমে বাহ্যিকভাবেই রোপণ করা চারার ওপর পড়া আলো, আলোকতরঙ্গের দৈর্ঘ্য, তাপমাত্রা, চারার পানি ও লবণসহিষ্ণুতা ইত্যাদি বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন করে বিভিন্ন প্রতিকূল পরিবেশসহিষ্ণু ফসলের জাত উদ্ভাবনের গবেষণা করা হচ্ছে।
অ্যাগ্রোমেটিওরোলজি বিভাগের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী তানজিম আহমেদ কাজ করছেন জলবায়ুসহিষ্ণু ভুট্টার জাত উদ্ভাবন নিয়ে। তিনি দুটি আলাদা কক্ষে ভুট্টার একই জাত নিয়ে গবেষণা করছেন। একটিতে স্বাভাবিক তাপমাত্রা এবং অন্যটিতে অতিরিক্ত তাপমাত্রা রেখেছেন। এই অতিরিক্ত তাপমাত্রার ফলে ভুট্টাগাছে কী কী পরিবর্তন আসে এবং ওই পরিবর্তনগুলো কীভাবে প্রশমিত করা যায়—সেটি নিয়েই কাজ করছেন তানজিম। গবেষণাটি সফল হলে অতিরিক্ত তাপমাত্রার অঞ্চলগুলোতেও তাপমাত্রাসহিষ্ণু উচ্চফলনশীল ভুট্টার জাত চাষ করা যাবে বলে জানান তিনি।
লবণাক্ততা ও উচ্চ তাপমাত্রাসহিষ্ণু ধানের জাত উদ্ভাবন নিয়ে কাজ করছেন স্নাতকোত্তরের আরেক শিক্ষার্থী জাবের সবুজ। উদ্ভাবিত ধানের জাত দিয়ে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় ১৯টি জেলায় লবণাক্ততার মধ্যেও ধানের চাষ অব্যাহত রাখা সম্ভব হবে বলে জানান জাবের।
শীতকালীন জনপ্রিয় সবজি টমেটো যেন গ্রীষ্মকালেও উৎপাদন করা যায়, সে লক্ষ্যে কাজ করছেন স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী সিরাজুম মনিরা। তিনি মূলত টমেটোর অতিরিক্ত তাপমাত্রাসহিষ্ণু জাত উদ্ভাবন নিয়ে কাজ করছেন। গ্রিনহাউসের মধ্যে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে তার ভিত্তিতে টমেটোগাছের শরীরতাত্ত্বিক পরিবর্তন লক্ষ্য করে ওই জাত উদ্ভাবন করা হবে। এর ফলে গ্রীষ্মকালেও টমেটো উৎপাদন করা সম্ভব হবে।
বাংলাদেশে বোরো মৌসুমে জলাবদ্ধ পদ্ধতিতে ধান চাষে উৎপাদন ভালো হয়। কিন্তু এই পদ্ধতির চাষে একটি বড় সমস্যা হচ্ছে এটি বেশি পরিমাণে মিথেন গ্যাস নিঃসরণ করে, যা পরিবেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী ফারজানা আক্তার কাজ করছেন জলাবদ্ধ পদ্ধতিতে চাষ করে ফলন ঠিক রাখে এবং মিথেন গ্যাসের নিঃসরণ কম করে, এমন ধানের জাত উদ্ভাবন নিয়ে।
গবেষক অধ্যাপক আরিফ হাসান খান বলেন, বাংলাদেশ এমন একটি দেশ, যার মৌসুমগুলো হিমালয় ও বঙ্গোপসাগর—দুটি দ্বারাই অনেকাংশে প্রভাবিত। দেশের এই ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বিপুল পরিমাণ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ঝুঁকিতে থাকতে হয় সব সময়। এর ফলে জলবায়ু পরিবির্তনের প্রভাবও দেশে দিন দিন প্রকট হচ্ছে, যার সর্বাধিক বিরূপ প্রভাব পড়ছে কৃষিতে। তাঁরা একটি অত্যাধুনিক গ্রিনহাউস প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছেন; যার মাধ্যমে টমেটো, ভুট্টা, ধানসহ বিভিন্ন ফসলের বিরূপ আবহাওয়াসহিষ্ণু জাত উদ্ভাবন করার গবেষণা চলমান আছে।