শরীয়তপুরের মিষ্টি, দই ও ঘিয়ের সুনাম দেশজুড়ে। তবে যোগাযোগব্যবস্থা ভালো না থাকায় দুগ্ধজাত এসব পণ্যের বিক্রি ভালো ছিল না। সীমিত কিছু পদের মিষ্টি তৈরি করতেন ব্যবসায়ীরা। এতে খুব বেশি লাভের মুখ দেখা হতো না।
পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর দুই বছর ধরে শরীয়তপুরের মিষ্টির ব্যবসা সম্প্রসারণ হয়েছে। নানা পদের মিষ্টি তৈরি হচ্ছে কারখানাগুলোতে। মিষ্টি যাচ্ছে ঢাকার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ও মানুষের বাড়িতে। মিষ্টি ও দুগ্ধপণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় মিষ্টি ব্যবসায়ীদের সুদিন ফিরেছে।
শরীয়তপুর জেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয় সূত্র জানায়, শরীয়তপুরের বিভিন্ন এলাকায় ছোট–বড় মিলে গাভির খামার রয়েছে ৮ হাজার ৯৪টি। এসব খামার থেকে প্রতিদিন তিন হাজার টন দুধ উৎপাদন হয়, যার ৫০ শতাংশ বিক্রি হয় ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও চাঁদপুরে। ৫০ শতাংশ স্থানীয় মানুষের চাহিদা পূরণ ও মিষ্টির কারখানাগুলোতে ব্যবহার করা হয়। জেলায় মিষ্টির ছোট-বড় ৩৫০টি দোকান রয়েছে। কারখানার সংখ্যা আড়াই শতাধিক।
মিষ্টি ব্যবসায়ীরা জানান, জেলায় ৩৫০টি দোকানে বিক্রির জন্য ২৫০টি কারখানায় মিষ্টি তৈরি করা হয়। ২ বছর আগে কারখানাগুলোতে প্রতিদিন ৪৫ হাজার কেজি থেকে ৫০ হাজার কেজি মিষ্টি, ৮ হাজার থেকে ১০ হাজার কেজি দই, দেড় হাজার হতে ২ হাজার কেজি ঘি তৈরি হতো। এখন ২৫০টি কারখানায় প্রতিদিন গড়ে ৯০ হাজার থেকে ১ লাখ ১০ হাজার কেজি মিষ্টি, ১৫ হাজার থেকে ২০ হাজার কেজি দই ও গড়ে ৩ হাজার কেজি ঘি তৈরি হচ্ছে। প্রতিদিন সাড়ে ৪ কোটি থেকে ৫ কোটি টাকার মিষ্টি, ৫০ লাখ থেকে ৬০ লাখ টাকার দই ও ৪০ লাখ থেকে ৪৫ লাখ টাকার ঘি বিক্রি করছেন শরীয়তপুরের ব্যবসায়ীরা।
দুই বছর আগে ব্যবসায়ীরা ছানার তৈরি রসগোল্লা, সন্দেশ, চমচম, কালোজাম, মাষকলাইয়ের আমিত্তি ও ময়দার জিলাপি বিক্রি করতেন। সেই সঙ্গে তৈরি করতেন দই ও ঘি। প্রতি কেজি মিষ্টি ২০০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা দামে বিক্রি করা হতো। ২০২২ সালের জুনে পদ্মা সেতু চালুর পর জেলা শহর থেকে দেড় ঘণ্টায় ঢাকায় পৌঁছানো যাচ্ছে। তাই শরীয়তপুরের মিষ্টির চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে। দোকানিরা নানা প্রকার মিষ্টি তৈরি করছেন। ছানার পাশাপাশি বিভিন্ন পদের ক্ষীরের মিষ্টিও তৈরি করা হচ্ছে।
শরীয়তপুরের তৈরি রসগোল্লা, নানা পদের সন্দেশ, মুক্তা মিষ্টি, ক্রিম টোস্ট, সরমালাই, কাটারি ভোগ, মালাই চমচম, মালাইকারি, সরভোগ, রসমালাই, ক্ষীর চমচম, ক্ষীরপুরি, মিষ্টি দই, টক দই, মিষ্টিবিহীন দই, ঘি ও মাখন জনপ্রিয়। শরীয়তপুরের ছানা ও ক্ষীরের তৈরি প্রতি কেজি মিষ্টি ৩০০ টাকা থেকে ৮০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর মিষ্টি দই ও মিষ্টিবিহীন দই প্রতি কেজি ৩৫০ টাকা দামে বিক্রি হচ্ছে। টক দই বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকা কেজি করে। প্রতি কেজি ঘি বিক্রি হচ্ছে দেড় হাজার টাকায়।
পরিমল ঘোষ নড়িয়া উপজেলা সদর ও জেলা শহরে তিনটি মিষ্টির দোকান চালাচ্ছেন ১০ বছর ধরে। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর দোকানগুলোতে বিক্রি বেড়েছে দ্বিগুণ। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর দুই ছেলে ও এক জামাতা দোকানগুলো পরিচালনা করছেন। পরিমল ঘোষের ছেলে পংকজ ঘোষ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগে আমাদের তিনটি দোকানে প্রতিদিন ৬০০-৭৫০ কেজি দুধের মিষ্টি, দই ও ঘি তৈরি হতো। দুই বছর ধরে বিক্রি বেড়েছে। আমাদের তৈরি মিষ্টি ও অন্য সামগ্রী ক্রেতারা ঢাকায় নিয়ে যান। এখন প্রতিদিন ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ কেজি দুধের মিষ্টি তৈরি করা হয়।
শরীয়তপুর জেলা শহরে তিন প্রজন্ম ধরে মিষ্টির ব্যবসা করেন কমল ঘোষের পরিবার। গত দুই বছরে দোকানে ব্যবসা বেড়েছে। এখন দোকানটিতে নানা ধরনের ছানা ও ক্ষীরের মিষ্টি তৈরি করা হয়। কমল ঘোষ প্রথম আলোকে বলেন, আগে চার শ্রমিক দিয়ে কারখানা চলত। প্রতিদিন ২০০ কেজি দুধের মিষ্টি ও দই তৈরি হতো। এখন আট শ্রমিক কারখানায় ও আটজন দোকানে কাজ করছেন। প্রতিদিন ৪০০-৪৫০ কেজি দুধের মিষ্টি, দই ও ঘি তৈরি হচ্ছে। অনেকে তাঁদের কাছ থেকে মিষ্টি, দই ও ঘি নিয়ে ঢাকার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সরবরাহ করেন।
সোহাগ নামের এক ব্যক্তি ঢাকার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দই, মিষ্টি ও ঘি সরবরাহ করেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘শরীয়তপুরের বাসিন্দা যাঁরা ঢাকায় বসবাস করেন, তাঁদের নানা অনুষ্ঠানে মিষ্টি, দই ও ঘিয়ের প্রয়োজন হলে আমাকে ডাকা হয়। আমি চাহিদা অনুযায়ী মিষ্টি, দই, টক দই, ঘি শরীয়তপুরের বিভিন্ন মিষ্টির দোকানে অর্ডার করি। পদ্মা সেতুর কারণে যোগাযোগ সহজ হওয়ায় দ্রুততম সময়ে ওই সকল পণ্য নির্বিঘ্নে ঢাকায় পৌঁছে দিচ্ছি।’
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আবু বকর সিদ্দিক প্রথম আলোকে বলেন, শরীয়তপুরে উৎপাদিত দুধ নিয়ে একসময় খামারিরা বিপাকে ছিলেন। ঢাকার খুব কাছের জেলা ও সহজ যোগাযোগের কারণে এখন দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন খামারিরা প্রতি কেজি দুধ ৭০ টাকা থেকে ১০০ টাকা দামে বিক্রি করতে পারছেন। মিষ্টির দোকানগুলোতেও দুধের চাহিদা বেড়েছে। শরীয়তপুরে দুগ্ধজাত পণ্যের চাহিদা অনেক বৃদ্ধি পাওয়ায় এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত মিষ্টি ব্যবসায়ীদের সুদিন ফিরেছে।