চারদিকে সুনশান নিরবতা, কোনো মানুষের সাড়াশব্দ নেই। পুড়ে যাওয়া বাড়ির মধ্য উঠানে বিবর্ণ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মরতে বসা লিচুগাছটি। নাকে আসছে শুধুই ছাইয়ের গন্ধ।
আজ শুক্রবার সকাল সাড়ে আটটার দিকে পঞ্চগড় জেলা শহরের উপকণ্ঠে আহম্মদনগর এলাকায় গিয়ে মোরশেদ মিয়ার বাড়িতে এমন চিত্রই দেখা গেছে। জানা গেল, অগ্নিসংযোগের ঘটনায় মোরশেদ মিয়ার বাড়িঘরের সঙ্গে পুড়ে মারা গেছে তিনটি গরু। শোবার জায়গা না থাকায় সাত দিন ধরে সবাই থাকছেন মসজিদ আর ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে।
মোরশেদ মিয়ার বাড়ি থেকে বের হতেই পাশের বাড়িতে দেখা গেল, ছাইয়ে মাখা বারান্দায় বসে ছেলের পুড়ে যাওয়া ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন রাশিদা বেগম (৫৭)। কাছে যেতেই তিনি বললেন, ‘সব শেষ হয়ে গেছে বাবা। বড় ছেলে যে অটো (ইজিবাইক) চালিয়ে সংসার চালাত, সেটাও পুড়ে গেছে। সাত দিন ধরে জামেয়াতে (আহমদিয়া সম্প্রদায়ের নিজস্ব ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান) থাকতেছি। সেখানেই জামাত থেকে খাওয়ায়। সকালে ভয় ভয় করে শুধু একবার দেখতে আসলাম। পরনের কাপড় ছাড়া কিচ্ছু নাই, কিন্তু ভিটার মায়া তো ছাড়তে পারি না।’
গত শুক্রবার (৩ মার্চ) পঞ্চগড়ে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের ‘সালানা জলসা’ বন্ধের দাবিতে করা বিক্ষোভ থেকে আহম্মদনগর ও শালশিড়ি এলাকায় দেড় শতাধিক ব্যক্তির বাড়িঘরে হামলা হয়। আহমদিয়ারা ওই দিন দুপুরে বাড়িঘরে তালা দিয়ে জলসায় ছিলেন। এ সুযোগে বিকেল থেকেই দুষ্কৃতকারী ব্যক্তিরা তাঁদের বাড়িঘরে প্রথমে হামলা চালান। লুট করে নিয়ে যান সর্বস্ব। পরে বাড়িঘরে আগুন দিয়ে চলে যান তাঁরা।
আজ সকালে আহম্মদনগর গ্রামের পুড়ে যাওয়া বাড়িঘরে বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর সকাল সাড়ে ৯টার দিকে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে দেখা হয় মেরিনা আক্তার (৩০) নামের এক নারীর। তিন বছরের ছেলে মাহিদকে সঙ্গে নিয়ে পুড়ে যাওয়া নিজের বাড়িঘর দেখতে এলেন তিনি। কথা প্রসঙ্গে তিনি জানান, বেশ কিছুদিন আগে বিবাহবিচ্ছেদের পর বাবার বাড়িতেই একটি ঘর তুলে দুই ছেলেকে নিয়ে থাকছেন। বাবার সংসারে অভাব–অনটন থাকায় স্থানীয় একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন আয়া হিসেবে কাজ করেন তিনি। অনেক কষ্টে সাজানো ঘরটা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে তাঁর।
আক্ষেপ করে মেরিনা বলেন, ‘সব লুট করেছে, নিয়ে যাক, কিন্তু মাথা গোঁজার ঠাঁইটা অন্তত রাখুক। কিচ্ছু নেই যে কোনোরকম বিছানা করে ঘুমাব। সবাই ভয়ের মধ্যে আছে, কখন যে কী হয়, এ জন্য কেউই বাড়িতে আসতে চায় না।’
আহমদিয়াদের হিসাব অনুযায়ী, আহম্মদনগর এলাকায় ১৭৯টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। দোকানপাট, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানেও হামলা হয়। মিজানুর রহমান লিটন (৪০) নামের এক ভুক্তভোগী বলেন, ইজিবাইক চালিয়ে সংসার চলত তাঁর। ঘটনার দিন বাড়ির সবকিছুই লুটপাট করে নিয়ে গেছে। ভয়ে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে জামেয়াতে থাকছেন। কিন্তু আজ সকালে এসে দেখেন টিউবওয়েলে লাগানো মোটরটি (পাম্প) চুরি হয়েছে। চেষ্টা করেও খুলতে না পারায় মোচড় দিয়ে রেখে গেছে টিউবওয়েলটি।
আহম্মদনগরের বাসিন্দারা জানান, ঘটনার পর থেকে এক কাপড়েই আছেন তাঁরা। আহমদিয়া জামাত থেকে ধীরে ধীরে তাঁদের জন্য কিছু কাপড়ের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। আহমদিয়া সম্প্রদায়ের আহম্মদনগর মসজিদ ও শালশিড়ি মসজিদে রান্না করে তাঁদের খাবারের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এ ছাড়া রেলমন্ত্রী ও পঞ্চগড়-২ আসনের সংসদ সদস্যের পক্ষ থেকে ইতিমধ্যে তাঁদের একটি করে শাড়ি, একটি লুঙ্গি ও এক হাজার করে টাকা পেয়েছেন। এ ছাড়া মন্ত্রীর দেওয়া ৩০ কেজি করে চাল বাড়িতে জায়গা না থাকায় জামেয়াতে জমা রেখেছেন তাঁরা।
এদিকে ২ থেকে ৪ মার্চ হামলা অগ্নিসংযোগের ঘটনার পর এখন পর্যন্ত আহম্মদনগর, পার্শ্ববর্তী ফুলতলা ও শালশিড়ি এলাকায় পুলিশ ও বিবিজির সদস্যদের কঠোর নিরাপত্তাবেষ্টনী দেখা গেছে। এর আগে গত শুক্রবার জুমার নামাজের পর আহম্মদনগর এলাকায় শুরু হওয়া আহমদিয়া সম্প্রদায়ের তিন দিনব্যাপী সালানা জলসা বিক্ষোভের মুখে প্রশাসনের অনুরোধে রাতেই বন্ধ করে দেওয়া হয়। আজ জুমার দিন হওয়ায় সকাল থেকেই জেলা শহর ও আহমদিয়াদের ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোয় আবারও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
আহমদিয়া সালানা জলসার আহ্বায়ক আহমদ তবশির চৌধুরী বলেন, হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনার পর কারও বাড়িতেই কিছু নেই। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা এখনো আতঙ্কে রয়েছেন। আহমদিয়া জামাতের পক্ষ থেকে তাঁদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। সরকারিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের তালিকা তৈরি করেছে। তবে পুনর্বাসনের কোনো ঘোষণা এখনো পাননি। তাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের তালিকা তৈরি করেছেন। ধীরে ধীরে তাঁদের সহায়তা করার চেষ্টা করবেন। সেই সঙ্গে সরকার যদি ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেয়, তাহলে তা গ্রহণ করবেন।