প্রতি বছরের মতো এবারও কুমিল্লা নগরের নানুয়ার দিঘির পাড়ের অস্থায়ী মণ্ডপে শারদীয় দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বুধবার সকালে
প্রতি বছরের মতো এবারও কুমিল্লা নগরের নানুয়ার দিঘির পাড়ের অস্থায়ী মণ্ডপে শারদীয় দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বুধবার সকালে

দুর্গোৎসবে নানুয়ার দীঘির পাড়ে সম্প্রীতির বন্ধনে মেতে উঠতে চান সনাতনীরা

কুমিল্লায় যুগ যুগ ধরে সম্প্রীতির বন্ধনে বসবাস করেন হিন্দু-মুসলমান। কিন্তু তিন বছর আগে শারদীয় দুর্গোৎসবের সময় নগরের নানুয়ার দীঘির পাড়ে অস্থায়ী মণ্ডপে পবিত্র কোরআন রাখার ঘটনায় সারা দেশে ছড়িয়েছিল সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ। ওই ঘটনায় অবাক হয়েছিলেন কুমিল্লার নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। বছর ঘুরে আবারও এসেছে শারদীয় দুর্গোৎসব। এবারও নানুয়ার দীঘির পাড়ে বানানো হয়েছে নান্দনিক পূজামণ্ডপ। তবে এবার বিদ্বেষ নয়; বরং দুর্গোৎসবে সম্প্রীতির বন্ধনে মেতে উঠতে চান সনাতনীরা।

আজ বুধবার সকালে মহাষষ্ঠীর দিনে নানুয়ার দীঘির পাড়ে মণ্ডপে গেলে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা এমন কথাই বলেন। এরই মধ্যে অস্থায়ী মণ্ডপ তৈরির কাজ শেষ হয়েছে। প্রতি বছর নানুয়ার দীঘির উত্তর পাড়ে পূজামণ্ডপটি নির্মাণ করে দর্পণ সংঘ নামে একটি সংগঠন।

পূজামণ্ডপ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি শ্যামল কৃষ্ণ সাহা বলেন, ‘২০২১ সালের ওই ঘটনাকে আমরা মনে রাখতে চাই না। ওই ঘটনার পর গত দুই বছর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসনের আন্তরিকতা এবং নিরাপত্তায় আমরা উৎসবে মেতে উঠেছি। আশা করছি, এবারের আয়োজনটা আরও বর্ণাঢ্য হবে। আমরা আশাবাদী হিন্দু-মুসলিমসহ সব ধর্মের মানুষ মিলেমিশে আমরা সম্প্রীতির বন্ধনে মেতে উঠব।’

শ্যামল কৃষ্ণ সাহা আরও বলেন, মণ্ডপ তৈরির শুরু থেকেই প্রশাসন তাঁদের সহযোগিতা করে যাচ্ছে। পাশাপাশি তাঁদের নিজস্ব নিরাপত্তাব্যবস্থাও রাখা আছে। এ ছাড়া সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা রয়েছে। উৎসবে কোনো সমস্যা হবে না বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৪৫৮ সালে খনন হওয়া প্রাচীন নানুয়ার দীঘিটি কুমিল্লার ঐতিহ্য বহন করছে। এই দীঘির পাড়ে বসবাস ছিল দেশের বিশিষ্টজনদের। এখানে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাস প্রায় ৭০০ বছর ধরে। মুসলিম সম্প্রদায়ের বসবাস প্রায় ২৫০ বছর ধরে। হিন্দু-মুসলিমের মধ্যে ২৫০ বছর ধরেই আছে সম্প্রীতির বন্ধন, যা ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে বলে প্রত্যাশা সবার।

কুমিল্লার কোতোয়ালি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মহিনুল ইসলাম বলেন, হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন যেন নির্বিঘ্নে দুর্গোৎসবে মেতে উঠতে পারেন—সে জন্য পুলিশের পক্ষ থেকে সব ধরনের প্রস্তুতি আছে। সেনাবাহিনী, বিজিবি, র‍্যাব মাঠে আছে। পর্যাপ্তসংখ্যক পুলিশ ও অধিক গুরুত্বপূর্ণ মণ্ডপে আটজন এবং অন্যান্য পূজামণ্ডপে ছয়জন করে আনসার-ভিডিপির সদস্যরা দায়িত্ব পালন করছেন।

কুমিল্লার জেলা প্রশাসক মো. আমিরুল কায়ছার বলেন, এবার জেলায় ৭৯১টি ও নগরীতে ৬৯টি মণ্ডপে দুর্গোৎসব পালিত হচ্ছে। পূজার আনন্দ যেন কোনো অপশক্তি নষ্ট করতে না পারে, সে জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা মাঠে সর্বোচ্চ নজরদারি করছেন। পূজা নিয়ে কেউ ষড়যন্ত্র করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

কুমিল্লার ইতিহাস গবেষক আহসানুল কবীর বলেন, ঐতিহ্যগতভাবেই কুমিল্লা সাম্প্রদায়িক-সম্প্রীতির শহর। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়ও কুমিল্লায় কোনো মন্দির বা মণ্ডপে হামলার ঘটনা ঘটেনি। ২০২১ সালের ওই ঘটনা কুমিল্লার ইতিহাসের সঙ্গে একেবারেই বেমানান। ওই ঘটনাটিকে দিয়ে কুমিল্লার সম্প্রীতির বন্ধন ভেঙে ফেলারও সুযোগ নেই। কুমিল্লার শত বছরের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অতীতের মতোই ভবিষ্যতেও অটুট থাকবে বলে তিনি বিশ্বাস করেন।

প্রসঙ্গত, ২০২১ সালের ১৩ অক্টোবর নানুয়ার দীঘির পাড়ে দুর্গাপূজার সময় প্রতিমার মধ্যে পবিত্র কোরআন পাওয়ার ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ওই দিন নগরীর চারটি মন্দির ও সাতটি পূজামণ্ডপে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। সহিংসতার ঘটনায় আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় একজনের মৃত্যু হয়।