২০০৬ সাল থেকে প্রতি বিশ্বকাপেই জার্মানির বড় পতাকা বানিয়ে আসছেন কৃষক আমজাদ। এবার তাঁর পতাকার দৈর্ঘ্য সাড়ে সাত কিলোমিটার
২০০৬ সাল থেকে প্রতি বিশ্বকাপেই জার্মানির বড় পতাকা বানিয়ে আসছেন কৃষক আমজাদ। এবার তাঁর পতাকার দৈর্ঘ্য সাড়ে সাত কিলোমিটার

এবার সাড়ে সাত কিলোমিটার জার্মানির পতাকা বানাচ্ছেন মাগুরার আমজাদ

প্রায় দেড় যুগ ধরে বিশ্বকাপের সময় জার্মানির বড় পতাকা বানিয়ে আসছেন মাগুরার আমজাদ হোসেন (৭০)। প্রতি বিশ্বকাপেই তাঁর বানানো পতাকার দৈর্ঘ্য বাড়ে। ২০০৬ সালে প্রথমে দেড় কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের জার্মানির পতাকা তৈরি করেন তিনি। ২০১০ সালের বিশ্বকাপের সময় পতাকা হয় আড়াই কিলোমিটার দীর্ঘ। ২০১৪ সালে সাড়ে তিন কিলোমিটার। সর্বশেষ ২০১৮ সালে পতাকার দৈর্ঘ্য ছিল সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার। এবার কাতার বিশ্বকাপ উপলক্ষে আমজাদ হোসেন তৈরি করছেন সাড়ে সাত কিলোমিটার দীর্ঘ জার্মানির পতাকা।

আমজাদ হোসেনের বাড়ি মাগুরা পৌরসভার ঘোড়ামারা গ্রামে। তিনি পেশায় কৃষক। পাঁচ ছেলে ও পাঁচ মেয়ের জনক আমজাদ। বড় ছেলে মালয়েশিয়া থাকেন। এ ছাড়া দুই ছেলে ছোট চাকরি করেন। অন্য দুই ছেলে কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত। পাঁচ মেয়ের মধ্যে চারজনের বিয়ে হয়েছে। শুরুর দিকে পতাকা তৈরি করতে গিয়ে পরিবারের কারও সমর্থন না পেয়ে নাছোড়বান্দা আমজাদ জমি পর্যন্ত বিক্রি করেছেন। তবে এবার সন্তানেরাই পতাকা তৈরির খরচ দিয়েছেন।  

২০১৪ সালে তৎকালীন জার্মান রাষ্ট্রদূত মাগুরায় এসে আমজাদের পতাকা উদ্বোধন করেন। সে সময় তাঁকে জার্মান দূতাবাসের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। একই সঙ্গে জার্মান ফুটবল দলের ফ্যান ক্লাবের আজীবন সদস্যপদ পান তিনি।

আজ বুধবার সকালে আমজাদের বাড়িতে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। জানা গেল, এবার নতুন করে দুই কিলোমিটার দীর্ঘ পতাকা বানাচ্ছেন। নতুন এই পতাকা আগের বিশ্বকাপের সময় তৈরি সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার পতাকার সঙ্গে যুক্ত করা হবে। পতাকা তৈরির কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। এক সপ্তাহ ধরে চারজন দরজি মিলে পতাকা সেলাই করেছেন। আগামী শুক্রবার আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে স্থানীয় নিশ্চিন্তপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয় খেলার মাঠে সাড়ে সাত কিলোমিটার দীর্ঘ পতাকাটি প্রদর্শন করা হবে বলে জানালেন আমজাদ।

আমজাদ বলেন, এবার নতুন দুই কিলোমিটার পতাকা তৈরি করতে ইতিমধ্যে প্রায় ৯০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। এর মধ্যে কাপড়ে খরচ হয়েছে প্রায় ৭০ হাজার টাকা। পরিবহন ও সেলাইয়ের মজুরিতে বাকি টাকা খরচ হয়েছে। শুধু পতাকা তৈরি করেই আমজাদের বিশ্বকাপ উন্মাদনা শেষ হয় না, জার্মানির খেলার দিন বাড়িতে থাকে নানা আয়োজন। দল জিততে থাকলে আমজাদের খরচও বাড়তে থাকে।

মাগুরার কৃষক আমজাদ

আমজাদ আরও বলেন, ‘২০১৪ সালে আমার মা বাদে পরিবারের সবাই পতাকা তৈরির বিপক্ষে ছিল। কিন্তু আমি সেটা শুনিনি। ২০ শতক জমি বিক্রি করে দিছিলাম। সেবার খরচ হইছিল পাঁচ লাখ। বাড়িতে প্রজেক্টর কিনে নিছিলাম খেলা দেখার জন্য। দল চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর গরু দিয়ে মেজবান দিছিলাম।’

এরপর ২০১৮ সালের বিশ্বকাপের সময় আড়াই থেকে তিন লাখ টাকা খরচ করেছিলেন আমজাদ। তখন বিক্রি করেছিলেন প্রায় ১০ শতক জমি।

২০১৪ সালে তৎকালীন জার্মান রাষ্ট্রদূত মাগুরায় এসে আমজাদের পতাকা উদ্বোধন করেন। সে সময় তাঁকে জার্মান দূতাবাসের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। একই সঙ্গে জার্মান ফুটবল দলের ফ্যান ক্লাবের আজীবন সদস্যপদ পান তিনি। ২০১৮ সালেও জার্মান দূতাবাসের কর্মকর্তারা এসেছিলেন পতাকা প্রদর্শনী অনুষ্ঠানে। তবে এ বছর স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতেই নতুন পতাকা প্রদর্শনী করা হবে।

আমজাদ বলেন, ‘এবার পরিবারের কেউ বাধা দেয়নি। পতাকা তৈরির কথা বলার পর বড় ছেলে টাকা দিয়েছে। কারণ, তারা জানে আমি এটা করেই ছাড়ব। এই পতাকা আমার কাছে সন্তানদের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।’    

কিন্তু প্রতি বিশ্বকাপের সময় এত টাকা খরচ করে জার্মানির পতাকা তৈরির কারণ জানতে চাইলে আমজাদ বলেন, ২০০৫ সালের দিকে কঠিন পীড়ায় আক্রান্ত হন তিনি। বিভিন্ন ওষুধ খেয়েও কোনো কাজ হচ্ছিল না। তখন মাগুরা শহরের মনোরঞ্জন কবিরাজ নামের একজন চিকিৎসকের পরামর্শে জার্মানির তৈরি হোমিও ওষুধ সেবন করে আরোগ্য লাভ করেন। এর পর থেকেই জার্মানির প্রতি তাঁর ভালোবাসা। ২০০৬ সালে জার্মানিতে বিশ্বকাপ ফুটবলের আসর বসে। তখন তিনি মনে মনে ঠিক করেন, জার্মানির ওষুধ সেবন করে যেহেতু ভালো হয়েছেন, তাই দেশটিকে একটা উপহার দেবেন। তখন প্রায় ৩৫০ গজ লম্বা জার্মানির পতাকা তৈরি করেন।

আমজাদ বলেন, ‘ভালোবাসা থেকেই এগুলো করেছি। আর এটার জন্য কারও কাছে সাহায্যও চাইনি। এবার এই পতাকা জার্মানির দূতাবাসকে উপহার দিয়ে দেব। তারা হয়তো এটা জাদুঘরে সংরক্ষণ করবে।’