হামলায় আহত দুই শিক্ষার্থী। শুক্রবার রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে
হামলায় আহত দুই শিক্ষার্থী। শুক্রবার রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে

রাজশাহীর শাহ মখদুম মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের ওপর ফের হামলা, আহত ৫

দীর্ঘদিন ধরে নিবন্ধন না হওয়ায় অন্য প্রতিষ্ঠানে ভর্তির জন্য ছাড়পত্র চাইতে গিয়ে রাজশাহীর বেসরকারি শাহ মখদুম মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা হামলার শিকার হয়েছেন। শুক্রবার সকালে কলেজ ক্যাম্পাসে তাঁদের ওপর হামলা হয়। এতে পাঁচজন আহত হন। এ ঘটনায় শিক্ষার্থীরা থানায় একটি এজাহার দিয়েছেন।

এর আগে একইভাবে ২০২০ সালের ২৭ নভেম্বর শিক্ষার্থীদের মারধর করা হয়েছিল। তখনো নগরের চন্দ্রিমা থানায় একটি মামলা করা হয়েছিল। আজকের ঘটনায় বিকেলে সেনাবাহিনী ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে আসামিদের ধরার ব্যাপারে আশ্বাস দিয়েছে বলে শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন।

শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, কলেজের নিবন্ধন না হওয়ায় ২০২০-২১ ও ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের ৪২ শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এ জন্য তাঁরা ছাড়পত্র চাইতে গিয়েছিলেন। এ সময় প্রধান ফটক বন্ধ করে কলেজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মনিরুজ্জামান, তাঁর ভাই টিটু ও মিঠুসহ ভাড়াটে লোকজন তাঁদের ওপর হামলা করেন।

শুক্রবার সকালের এ হামলার ঘটনায় কলেজের পাঁচ শিক্ষার্থী আহত হন। তাঁদের মধ্যে মেহেদী হাসান ও সোহেলুল হক রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। অন্য তিনজন অন্যত্র চিকিৎসা নিয়েছেন। আহত ছাত্র সাইমন ইকবাল বাদী হয়ে কলেজ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে চন্দ্রিমা থানায় একটি এজাহার দিয়েছেন।

দুই শিক্ষাবর্ষে ৪২ জন এমবিবিএস শিক্ষার্থী ভর্তির পর থেকে রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (রামেবি) ও বিএমডিসির নিবন্ধন পাচ্ছেন না। প্রতারণা করে তাঁদের ভর্তি করা হয়েছে বলে তাঁদের অভিযোগ। এ নিয়ে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা ২৩টি মামলাও করেছেন।

ঘটনার সময়ের ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, কলেজের অনুসন্ধান ডেস্কের সামনে বসে আছেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক মনিরুজ্জামান। কয়েকজন শিক্ষার্থী একটি ছাড়পত্র লিখে নিয়ে তাঁর হাতে দেন এবং ছাড়পত্রে সই করে দিতে অনুরোধ করছেন। এক শিক্ষার্থী বলছেন, ‘আপনি আমাদের জন্য কিছু করতে পারবেন না স্যার। আপনার দ্বারা সম্ভব না। আপনি এই এনওসিতে স্বাক্ষর করে দেন। আমরা অন্য কোথাও ভর্তি হয়ে যাই।’ তখন মনিরুজ্জামান বলেন, ‘তোমার কথায় তো আমি করব না। তোমাদের যে বক্তব্য সেটি আমাকে লিখিত দাও।’ তখন শিক্ষার্থীরা ছাড়পত্রে সই দিতে অনুরোধ করেন। এ সময় মনিরুজ্জামান বলেন, ‘আমি যেটা বলছি সেটি করতে হবে।’

প্রতারণার মামলা করা এক শিক্ষার্থীকে দেখে ক্ষুব্ধ হয়ে মনিরুজ্জামান বলেন, ‘তুমি না মামলা করেছ? তুমি আমার সামনে থেকে সরে যাও।’ ঠিক এ সময় পাশ থেকে শিক্ষার্থীদের ওপর চড়াও হন মনিরুজ্জামানের ভাই টিটু। মামলা করা এক শিক্ষার্থীকে গালি দিয়ে বলেন, ‘তুই আমাকে চিনিস না? তুই আমাকেও মামলার আসামি করেছিস কেন?’ এর পরই শিক্ষার্থীদের ধাক্কা দেওয়া শুরু হয়। পরে ধাওয়া দিয়ে ধরে ধরে শিক্ষার্থীদের পেটানো হয়।

আহত সোহেলুল হক বলেন, ‘আমরা গিয়ে বলেছিলাম স্যার আমাদের জীবনটা বাঁচান স্যার। তিন বছরেও আপনি কিছু করতে পারেননি। আমরা এনওসি এনেছি। আপনি সাইন করে দেন। এনওসিতে লেখা ছিল, “আমরা যেহেতু ওদের নিবন্ধনের ব্যবস্থা করতে পারছি না। অন্য কোথাও পড়াশোনা করলে আমাদের আপত্তি নেই।” এই এনওসিতে তিনি সাইন করলেন না। দুটি গেট বন্ধ করে এলোপাতাড়ি মারা হলো। মেয়েদেরও মেরেছে।’

মেহেদী হাসান বলেন, পত্রিকায় চটকদার বিজ্ঞাপন দেখে তাঁরা প্রতিষ্ঠানটিতে ভর্তি হন। এমবিবিএস প্রফেশনাল কোর্সে ভর্তির জন্য কেউ দিয়েছেন ১৫ লাখ, কেউ ১৮ লাখ। এরপর নিবন্ধন না পাওয়ায় শিক্ষার্থীরা ২৩টি মামলা করেছেন কলেজ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। এতে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ আনা হয়। এই মামলা করার পর ছাড়পত্র চাওয়ায় তাঁদের ওপর হামলা করা হয়েছে।

জানতে চাইলে কলেজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মনিরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা নিজেদের সুবিধামতো ভিডিও দেখাচ্ছে। তাঁরা যেগুলো করেছেন, তার ভিডিও দেখাচ্ছে না। ফলে আমরাই অপরাধী হয়ে যাচ্ছি। আমরা শিক্ষার্থীদের নিবন্ধনপ্রক্রিয়ার মধ্যেই আছি; কিন্তু বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আমরা ভুক্তভোগী হয়েছি, এখনো হচ্ছি।’

চন্দ্রিমা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মতিয়ার রহমান বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, ‘কলেজে ঠিক কী ঘটনা ঘটেছে সেটি বিস্তারিত জানি না। মারধরের অভিযোগে কলেজের এক শিক্ষার্থী থানায় এজাহার দিয়েছেন। সেটি মামলা হিসেবে নথিভুক্ত করে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

এর আগে ২০২০ সালের ২৭ নভেম্বর একইভাবে পঞ্চম ও ষষ্ঠ ব্যাচের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করা হয়েছিল। এতে অন্তত ১০ শিক্ষার্থী আহত হয়েছিলেন। তখন বেসরকারি মেডিকেল কলেজ স্থাপন ও পরিচালনা নীতিমালা না মানায় শাহ্ মখদুম মেডিকেল কলেজে ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে ছাত্রছাত্রী ভর্তি বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। বিষয়টি জানতে শিক্ষার্থী গেলে তাঁদের পেটানো হয়।

চলতি বছরের ২৩ মার্চ শাহ মখদুম মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষকে ‘প্রতারক’ দাবি করে অন্য মেডিকেল কলেজে মাইগ্রেশনের দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করেন প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থীরা। রাজশাহী সাংবাদিক ইউনিয়নের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন দুই শিক্ষাবর্ষের ৪২ শিক্ষার্থী। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পড়েন কলেজের অষ্টম ব্যাচের শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান (যিনি হামলায় আহত হয়েছেন)।

সংবাদ সম্মেলনে মেহেদী বলেছিলেন, কলেজ কর্তৃপক্ষের প্রতারণার কারণে ৪২ শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে। তাঁরা পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখে ভর্তি হন। বিজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়, শাহ মখদুম মেডিকেল কলেজ স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদিত ও রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত; কিন্তু ভর্তির দুই বছর পর জানতে পারেন, কলেজটির বিএমডিসির অনুমোদন নেই। রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়েরও অধিভুক্ত নয়। কলেজ কর্তৃপক্ষ ভুয়া ও চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে শিক্ষার্থীদের ভর্তি করিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে।

এ বিষয়ে কলেজের পরিচালক মনিরুজ্জামান বলেন, ২০২০ সালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তাঁদের কলেজে শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধ করে দেয়। পরে মন্ত্রণালয়ের সেই আদেশের কার্যকারিতা উচ্চ আদালত স্থগিত করেন। তখন তাঁরা দুটি শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থী ভর্তি করেন। উচ্চ আদালতের নির্দেশনা থাকলেও রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় নিবন্ধন দিচ্ছে না। এ জন্য কলেজে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটছে। তিনি অভিযোগ করে বলেন, রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন উপাচার্য অধ্যাপক জাওয়াদুল হক একটি রাজনৈতিক দলের মানুষ। সেই দলের চিকিৎসকদের একটি অংশ স্বল্প টাকায় শাহ মখদুম মেডিকেল কলেজ কিনে নিতে চাচ্ছে। এই কারণে উপাচার্য তাঁদের নিবন্ধন না দিয়ে হয়রানি করছেন।

তবে উপাচার্য অধ্যাপক জাওয়াদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘কারা এই প্রতিষ্ঠান কিনতে চান, সে ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না। আসলে শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনার নিবন্ধন দিতে গেলে বেশ কিছু ক্রাইটেরিয়া দেখতে হয়। আমি বলেছি, এসব ঠিক থাকলে নিবন্ধন দিয়ে দেব; কিন্তু মনিরুজ্জামান কোনো নিয়মনীতির মধ্যে আসতে চান না। দীর্ঘদিন ধরে প্রতিষ্ঠানটিতে জটিলতা চলছে। ফলে আমরা নিবন্ধন দিতে পারছি না।’

উপাচার্যের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে মনিরুজ্জামান বলেন, উপাচার্য জাওয়াদুল হক একসময় তাঁদের প্রতিষ্ঠানের খণ্ডকালীন শিক্ষক ছিলেন। সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেছেন। তিনি প্রশ্ন তোলেন, ‘তখন প্রতিষ্ঠান ভালো ছিল, এখন খারাপ হয়ে গেছে?’