পাহাড়, ঝরনা, আঁকাবাঁকা পথ আর উঁচুনিচু সবুজ পাহাড়সমৃদ্ধ খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা। শীত মানেই পাহাড়ের অন্য রকম সৌন্দর্য। ভোরের কুয়াশায় পাহাড়ের রূপ যেন আরও বৃদ্ধি পায়। খাগড়াছড়ি ভ্রমণপিপাসুদের পছন্দের শীর্ষে। অনেকে একদিনের ছুটিতে খাগড়াছড়িতে আসেন। কিন্তু কোথায় ঘুরবেন, তা নিয়ে সময়ের হিসাব কষতে থাকেন অনেকে।
ঢাকা থেকে বাস বা ব্যক্তিগত বাহনে রাতে রওনা দিয়ে ভোরে পৌঁছে যাবেন খাগড়াছড়ি। সকালের নাশতা সেরে দিনভর ঘুরে দেখতে পারেন খাগড়াছড়ির এ ছয়টি স্থান। ব্যক্তিগত বাহন না থাকলে সারা দিনের জন্য ভাড়া নিতে পারেন চাঁদের গাড়ি নামে পরিচিত ফোর হুইল জিপ, সিএনজি অটোরিকশা বা মাইক্রোবাস।
আলুটিলা গুহা
আলুটিলা গুহা খাগড়াছড়ির অন্যতম জনপ্রিয় দর্শনীয় স্থান। এটি আলুটিলা পর্যটনকেন্দ্রে অবস্থিত এক প্রাকৃতিক গুহা। এটিকে দেবতার গুহাও বলা হয়ে থাকে। যাঁরা রোমাঞ্চ পছন্দ করেন, তাঁদের দারুণ লাগবে এই গুহা। ৩৬৫টা সিঁড়ি পার নেমে যেতে হয় গুহার প্রবেশ মুখে। আলো প্রবেশ করতে পারে না বিধায় গুহাটি খুবই অন্ধকার ও শীতল। এ জন্য ভেতরে প্রবেশ করার সময় অবশ্যই টর্চলাইট বা মশাল জ্বালিয়ে নিতে হয়। পিচ্ছিল এ পাথুরে গুহায় আলো জ্বালিয়ে প্রবেশ করলে দারুণ এক অনুভূতি হবে। গুহার এপাশ থেকে ওপাশ যেতে সময় লাগে প্রায় ১৫ থেকে ২০ মিনিট। দৈর্ঘ্য ৩৫০ ফুট। ৪০ টাকা প্রবেশ ফি দিয়ে প্রবেশ করতে হয়। খাগড়াছড়ি সদর থেকে মাত্র ৭ কিলোমিটার দূরে মাটিরাঙ্গা উপজেলায় এটি অবস্থিত।
রিসাং ঝরনা
আলুটিলা গুহার কাছেই মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে রিসাং ঝরনা। এ ঝরনার কাছেই আবার আরেকটি ঝরনা আছে, যার দূরত্ব ২০০ গজও হবে না। প্রায় ৩০ মিটার উঁচু পাহাড় থেকে আছড়ে পড়া পানি দেখলেই পানিতে নামতে ইচ্ছা করবে। শরীর জুড়িয়ে নিতে ইচ্ছা হবে ঝরনার প্রবহমান ধারায়। এই শীতেও আছে ঝরনার পানি। তবে পানি থাকবে আগামী মাস পর্যন্ত।
খাগড়াছড়ি সদর থেকে রিসাং ঝরনার দূরত্ব ১১ কিলোমিটার। কেউ একা আসতে চাইলে মোটরসাইকেলে খাগড়াছড়ি থেকে জনপ্রতি ১০০ টাকা আর লোকাল বাসে জনপ্রতি ভাড়া ৪০ টাকা।
হাতিমাথা
হাতিমাথা মূলত একটি দুর্গম পাহাড়। এর চূড়া থেকে আশপাশের অন্যান্য পাহাড়, পাহাড়ের পাদদেশে সবুজ গাছপালা, মেঘ পাহাড়ের লুকোচুরি খেলাসহ পাহাড়িদের নির্মিত ঘর-জীবনবৈচিত্র্য দেখা যায়। চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড এ পাহাড়ে ৩০৮ ফুট লম্বা লোহার সিঁড়ি তৈরি করেছে। এই দুর্গম সিঁড়িপথ দিয়ে ১৫ গ্রামের বাসিন্দারা চলাচল করে। অনেকের কাছে এটি স্বর্গের সিঁড়ি নামে পরিচিত।
এখানে যেতে চাইলে সবচেয়ে ভালো হয় একজন স্থানীয় লোককে গাইড হিসেবে নিয়ে গেলে। কারণ, প্রথম কেউ যেতে চাইলে পথবিভ্রাট হতে পারে। খাগড়াছড়ি সদর থেকে পানছড়ি যাওয়ার পথে জামতলী যাত্রীছাউনি নামতে হবে। এরপর জামতলী থেকে চেঙ্গী নদী পার হয়ে প্রায় দেড় ঘণ্টা ট্রেকিং করে এই পাহাড়ে যেতে হবে। খাগড়াছড়ি চেঙ্গী স্কয়ার থেকে জামতলী পর্যন্ত অটোরিকশা ভাড়া ২০ টাকা ভাড়া। এরপর হাঁটাপথ।
আলুটিলা পর্যটনকেন্দ্র
ঝুলন্ত সেতু, গোলচত্বর, নয়নাভিরাম হাঁটাপথ আর পাহাড়ে ধাপ কেটে তৈরি করা সিঁড়ি নিয়ে নতুন সাজে সেজেছে খাগড়াছড়ির আলুটিলা পর্যটনকেন্দ্র। পর্যটকেরা শান্ত সমাহিত পাহাড়ের রূপও উঁচু পাহাড়ের বেদিতে দাঁড়িয়ে দেখতে পারবেন খাগড়াছড়ি শহরের বিস্তার। খাগড়াছড়ি শহর থেকে ৭ কিলোমিটার দূরে চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি সড়কের পাশে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৬০০ ফুট উঁচু পাহাড়ের পাদদেশে আলুটিলা পর্যটনকেন্দ্রের অবস্থান। ২০০ একর জায়গাজুড়ে অবস্থিত এই পর্যটনকেন্দ্র। বৌদ্ধ স্থাপত্যে গড়া দৃষ্টিনন্দন তোরণ পার হলেই দুই পাহাড় নিয়ে গড়ে ওঠা পর্যটনকেন্দ্র। দুই পাহাড়কে যুক্ত করতে তৈরি করা হয়েছে ১৮৪ ফুট দীর্ঘ লোহার ঝুলন্ত সেতু (কেবল্ ব্রিজ)। এই সেতুতে আছে কাচের ব্যালকনি। পাহাড়ের বাঁ দিকে সড়ক ধরে গেলেই দেখা মিলবে ভিউ পয়েন্ট। আর ডান দিকের সড়ক ধরে এগোলেই দুই গজ দূরে ভিউ পয়েন্ট কুঞ্জছায়া, আড্ডা দেওয়ার স্থান নন্দনকানন। কুঞ্জছায়া আর নন্দনকাননের সাদা গোলচত্বর আর বসার বেঞ্চ প্রকৃতির কোলে তন্ময় হতে দর্শকদের হাতছানি দেবে। তার পাশে আছে কাঠের তৈরি আরও একটি ঝুলন্ত সেতু। গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে দেখা যাবে খাগড়াছড়ি শহর। কাঠের কিংবা লোহার সেতু পার হয়ে নান্দনিক সিঁড়ি বেয়ে দর্শনার্থীরা আসবেন নন্দনকানন ও কুঞ্জছায়ায়। এর পাশেই পাহাড়ে খাঁজ কেটে তৈরি করা হচ্ছে ৭০০ আসনবিশিষ্ট অ্যাম্ফিথিয়েটার। এই অ্যাম্ফিথিয়েটারে প্রতি শুক্র ও শনিবার বিকেলে অনুষ্ঠিত হয় চাকমা আর ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের গীতিনাট্য রাধামন-ধনপুদি ও খেলাংবায়।
জেলা পরিষদ পার্ক
খাগড়াছড়ি চেঙ্গী স্কয়ার থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের তত্ত্বাবধানে নির্মিত সবুজ বেষ্টনীতে ঘেরা মনোরম সুন্দর পরিবেশে হর্টিকালচার হ্যারিটেজ পার্ক বা জেলা পরিষদ পার্ক শহরের অন্যতম বিনোদন কেন্দ্র। জেলা শহরের জিরোমাইল এলাকায় ২২ একর পাহাড়জুড়ে নির্মাণ করা হয়েছে এই হর্টিকালচার হ্যারিটেজ পার্ক। এই পার্কে রয়েছে অসাধারণ সুন্দর একটি ঝুলন্ত ব্রিজ এবং বড় একটি লেক। হর্টিকালচার পার্কের ভেতরের পরিবেশ বেশ মনোরম। পার্কের পশ্চিম পাশ থেকে খাগড়াছড়ি শহরের ভিউটা অসাধারণ। এ ছাড়া পার্কের ভেতরে রয়েছে দোলনা, ওয়াচ টাওয়ার, ফুলের বাগান ও বিভিন্ন প্রজাতির ফলগাছ। এ ছাড়া শিশুদের জন্য রয়েছে কিডস জোন। আছে পার্কের ভেতর পিকনিক করার জন্য বেশ কয়েকটি স্পট।
নিউজিল্যান্ড পাড়া
খাগড়াছড়ি শাপলা চত্বর থেকে মাত্র দেড় কিলোমিটার দূরে নিউজিল্যান্ড পাড়া অবস্থিত। পানখাইয়া পাড়া ও পোরাছড়ার কিছু অংশ নিউজিল্যান্ডের মতো হওয়ায় স্থানীয় লোকজনের কাছে এটি নিউজিল্যান্ড পাড়া হিসেবে পরিচিত। এমনকি পানখাইয়া পাড়া থেকে পোরাছড়া গ্রামে যাওয়ার রাস্তাটির নামকরণ স্থানীয় লোকজন করেছেন নিউজিল্যান্ড সড়ক নামে। সমতল ভূমিতে সবুজ শস্যখেত, সাদা মেঘের ভেলা ও পাহাড় মিলে দারুণ এক প্রাকৃতিক ল্যান্ডস্কেপ এ স্থানটি। নয়নাভিরাম এ প্রকৃতিতে চোখ রাখলে চোখ জুড়িয়ে যাবে। নিউজিল্যান্ড পাড়ায় বসে আলুটিলা পাহাড়ের সৌন্দর্য আর সূর্যাস্ত দেখলে যে কারোর মন ভালো হয়ে যাবে।
যেভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে খাগড়াছড়ি সরাসরি বেশ কিছু বাস চলাচল করে। এর মধ্যে জনপ্রিয় হলো সেন্টমার্টিন পরিবহন। এ ছাড়া হানিফ, শ্যামলী, ইগল পরিবহন ইত্যাদি বাস চলে। বাসভেদে এবং এসি, নন–এসিভেদে এসব বাসের ভাড়া ৭৫০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকা।
খাগড়াছড়িতে বেশি মানুষ গেলে কম টাকা খরচ হয়। যাওয়ার পর ১০ থেকে ১৫ জন মিলে চাঁদের গাড়ি বা জিপ ভাড়া করে দর্শনীয় স্থান একসঙ্গে দেখতে পারেন। জিপ বা চাঁদের গাড়ি ভাড়া নেবে পাঁচ থেকে সাত হাজার টাকা। চার থেকে পাঁচজন হলে সিএনজিচালিত অটোরিকশাও ভাড়া নেওয়া যায়। ভাড়া নেবে ৪ হাজার থেকে ৩ হাজার ৫০০ টাকা। একা হলে একদিনের জন্য মোটরসাইকেল ভাড়া নেওয়া যায়। তবে অবশ্যই আগে দরদাম করে ভাড়া মিটিয়ে নিতে হবে।
যেখানে থাকবেন
খাগড়াছড়িতে থাকার জন্য বেশ কিছু আবাসিক হোটেল রয়েছে। এর মধ্যে পর্যটন মোটেল, হোটেল গাইরিং, অরণ্য বিলাস, গিরি থেবার, হোটেল ইকো ছড়ি ইন উল্লেখযোগ্য। এসব হোটেলে ৫০০ থেকে ৪ হাজার টাকায় থাকা যায়।
যা খাবেন
যেহেতু এটা পাহাড়ি এলাকা, তাই পাহাড়ি খাবারের স্বাদ নিতে ভুলবেন না। পাহাড়ি খাবারের মধ্যে জুমের সবজি, বাঁশ কোঁড়ল, ব্যাম্বু চিকেন, ব্যাম্বু ফিশ, জুম ডাল, পাজন ইত্যাদির স্বাদ নিতে পারেন।
খাগড়াছড়ি শহরের ভালো মানের পাহাড়ি রেস্তোরাঁর মধ্যে আছে সিস্টেম, হেরিটেজ ডাইন, ব্যাম্বুশুট আর শাপলা চত্বরের মক্কা হোটেল। এসব রেস্তোরাঁয় খাবারের দামও তেমন না। ২০০ টাকায় মধ্যে একজন খাবার খেতে পারবে ভালো করে।