‘আমার সব শেষ হয়া গ্যাছে। যে মানুষটা এক সপ্তাহ টেকা না পাঠাইলে আমাগো খাবার জুটে না, সে আর নাই। এখন একবেলা চাল কেনারও উপায় নাই। কীভাবে চলব কোনো কূল পাই না।’
শুক্রবার বিকেলে বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের পানি মুছতে মুছতে এসব কথা বলেন মাজেদা বেগম (৩৯)। তিনি ঢাকায় কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সংঘাতের সময় গুলিতে নিহত দোকানি আবু সায়েদের (৪৫) স্ত্রী।
নিহত আবু সায়েদের বাড়ি পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়নের নতুনবস্তি এলাকায়। তিনি ঢাকার মোহাম্মদপুরের বছিলা এলাকায় ছোট একটি মুদিদোকান চালাতেন। গতকাল বিকেলে বোদার নতুনবস্তি এলাকায় নিহত সায়েদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, পুরোনো টিনের চালার মাটির ঘর। স্বজন ও প্রতিবেশীরা জানালেন, এক সপ্তাহ ধরে স্বামী হারানোর শোকে কাঁদতে কাঁদতে ভেঙে পড়েছেন মাজেদা।
আহাজারি করতে করতে মাজেদা বেগম বলেন, ‘বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই) আমার লগে তাঁর (সায়েদের) ফোনে কথা হইছিল। বলছিল, গতকাল বিকেলে চাল কেনার জন্য বিকাশে টেকা পাঠাইব। কিন্তু ওই দিন (১৯ জুলাই) বিকেলে তো গুলি খাইয়া মারাই গেল। ওর মাথার ডান দিকে গুলি ঢুইকা বাম দিকে বের হয়া গ্যাছে।’
স্বজন, প্রতিবেশী ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, আবু সায়েদের পূর্বপুরুষ কয়েক যুগ আগে টাঙ্গাইল থেকে এসে নতুনবস্তি এলাকায় বসবাস শুরু করেন। সাত ভাইয়ের মধ্যে আবু সায়েদ পঞ্চম। নিজের ভিটেবাড়ির ১৪ শতাংশ জমি ছাড়া আর কোনো আবাদি জমি নেই। নিহত আবু সায়েদের এক ছেলে, এক মেয়ে। মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন প্রায় পাঁচ বছর আগে। ছেলেটা এবার এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিল। একটা সময় এলাকায় সবজি ব্যবসা করতেন আবু সায়েদ। স্থানীয় বাজারে সবজি কিনে পাঠাতেন দেশের বিভিন্ন জেলায়। ১০ বছর আগে ব্যবসায় লোকসান গুনে ঢাকায় যান তিনি। সেখানে প্রথম দিকে রিকশা চালালেও পরে তিনি মোহাম্মদপুরের বছিলা এলাকায় ছোট একটি মুদিদোকান চালানো শুরু করেন। থাকতেন ভাড়া বাসায়। প্রায় তিন বছর আগে সেখানে আরেকটা বিয়েও করেছিলেন তিনি। সেই সংসারে আট মাস বয়সী এক ছেলে আছে তাঁর।
নিহত আবু সায়েদের ভাবি (বড় ভাইয়ের স্ত্রী) হামেলা খাতুন বলেন, তাঁরা শুনেছেন সায়েদ ১৯ জুলাই বিকেলে দোকান খুলে পলিব্যাগ কিনতে রাস্তা পার হন। এ সময় কোথা থেকে যেন একটি গুলি এসে তাঁর মাথায় লাগে। তিনি মাটিতে পড়ে যান। পরে বাসার মালিকের মাধ্যমে তাঁরা খবর পান, সায়েদ মারা গেছেন।
মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আবু আনসার মো. রেজাউল করিম মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, অনেক কষ্টে তাঁর গ্রামের সংসার চলত।
আবু সায়েদের ভাতিজা ফজলে রাব্বী বলেন, ২০ জুলাই সকালে বাড়ির পাশেই গোরস্থানে তাঁর চাচার লাশ দাফন করা হয়েছে। ব্যবসায় লোকসান গুনে তাঁর চাচা ভিটেবাড়ির ১৪ শতাংশ জমির ওপরে কৃষি ব্যাংক থেকে ৪৫ হাজার টাকা ঋণ করেছিলেন। সুদ-আসলে সেই ঋণ নাকি এখন ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা হয়েছে। চাচা মারা যাওয়ার পর তাঁর সংসার চালানোই কঠিন। এখন তাঁর পরিবার কীভাবে ঋণ শোধ করবে, সে নিয়ে চিন্তার কথা জানালেন তিনি।