চাঁদপুর মাছঘাটের সামনে রেলের জমিতে কয়েকটি টিনের ঘর। এগুলোর একটিতে বসে সজীব চন্দ্র দাস নামের এক যুবক মুঠোফোনে মাছের ‘অর্ডার’ (ফরমাশ) নিচ্ছেন। পাশে ছোট দুটি ঘরে দেখা গেল, পাঁচ–ছয়জন বরফ দিয়ে মাছ প্যাকেট করছেন, কেউ করছেন ফ্রিজিং (বরফ দিয়ে সংরক্ষণের কাজ)। আবার মুঠোফোনে ঢাকার এক নারীকে মাছের ওজন করা ও প্যাকেটজাত করার প্রক্রিয়া ভিডিও কলে দেখাচ্ছেন একজন।
এ দৃশ্য গত ২৫ সেপ্টেম্বর বেলা ১১টায় চাঁদপুরের ইলিশঘাটের। ঘাটের ওই ছোট ঘরগুলো থেকে সামাজিক যোগাযোগের জনপ্রিয় মাধ্যম ফেসবুকে তিনটি পেজের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন স্থানে ইলিশসহ ফরমাশ করা মাছ পাঠান সজীব চন্দ্র। ‘সজীব ইলিশের বাজার’, ‘সজীব ইলিশ’ ও ‘মাছের মেলা’—তিনটি পেজ চালান তিনি।
এদিকে মাছঘাটের আড়তদার ও অনলাইনে ইলিশের ব্যবসায়ী সাগর ব্যাপারীকে ওই দিন দুপুর পর্যন্ত অনলাইনে ২১ জন গ্রাহকের ১২০ কেজি ইলিশের অর্ডার নিতে দেখা গেল। সাগর জানান, তিনি প্রতিদিন গড়ে তিন–চার লাখ টাকার মাছ সারা দেশে পাঠাচ্ছেন।
আমি ৭টি ইলিশ ১ হাজার ৮০০ টাকা করে কিনে কামরাঙ্গীরচরের ওই গ্রাহককে কেজিপ্রতি ৫০ টাকা লাভ রেখে বিক্রি করেছি। গ্রাহককে কুরিয়ার চার্জ বাবদ অতিরিক্ত ৭০০ টাকা দিতে হয়েছে। প্যাকেট করার খরচও রাখছি। গ্রাহকেরা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে মাছের মূল্য পাঠান।সজীব চন্দ্র দাস, চাঁদপুর মাছঘাটের ব্যবসায়ী
এ ঘাট থেকেই ‘তাজা ফিস’ নামের একটি ফেসবুক পেজের মাধ্যমে ইলিশ ও অন্যান্য মাছের ব্যবসা করছেন রোকেয়া প্রীতি। তিনি জানান, বিভিন্ন জেলার পাশাপাশি বিদেশ থেকেও প্রচুর অর্ডার পান। প্রতিদিন অন্তত লাখ টাকার মাছের ব্যবসা তাঁর।
সজীব, সাগর, রোকেয়া—তাঁদের মতোই চাঁদপুরে তালিকাভুক্ত অনলাইন মাছ ব্যবসায়ী আছেন ৪১ জন। এসব তরুণ উদ্যোক্তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন নারী। তালিকার বাইরেও ব্যক্তিগতভাবে অনেক তরুণ-তরুণী ইলিশ মৌসুমে অনলাইনে মাছ বিক্রি করছেন। সব মিলিয়ে অনলাইনে চাঁদপুর থেকেই দেশের ৬৪ জেলায় প্রতিদিন গড়ে ৬০ মণের মতো মাছ বিক্রি হচ্ছে বলে জানা গেছে।
সজীব চন্দ্র দাস বলেন, ২৫ সেপ্টেম্বর বেলা ১১টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত অনলাইনে মাছের ১৫টি অর্ডার পেয়েছেন তিনি। তবে মাছ বিক্রি করতে সম্মত হয়েছেন তিনজনের কাছে। এর মধ্যে ঢাকার কামরাঙ্গীচরের রোকসানা বেগম সাতটি ইলিশ ও দুই কেজি চিংড়ি অর্ডার করেছেন; যার দাম হয়েছে ২০ হাজার ৪০০ টাকা।
সজীব, সাগর, রোকেয়া—তাঁদের মতোই চাঁদপুরে তালিকাভুক্ত অনলাইন মাছ ব্যবসায়ী আছেন ৪১ জন। এসব তরুণ উদ্যোক্তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন নারী। তালিকার বাইরেও ব্যক্তিগতভাবে অনেক তরুণ-তরুণী ইলিশের মৌসুমে অনলাইনে মাছ বিক্রি করছেন। সব মিলিয়ে অনলাইনে চাঁদপুর থেকেই ৬৪ জেলায় প্রতিদিন গড়ে ৬০ মণের মতো মাছ বিক্রি হচ্ছে বলে জানা গেছে।
প্রায় চার বছর আগে করোনাকালে শুরু করা অনলাইনে এ মাছের ব্যবসাই এখন সজীবের একমাত্র পেশা। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘আমি ৭টি ইলিশ ১ হাজার ৮০০ টাকা করে কিনে কামরাঙ্গীরচরের ওই গ্রাহককে কেজিপ্রতি ৫০ টাকা লাভ রেখে বিক্রি করেছি। গ্রাহককে কুরিয়ার চার্জ বাবদ অতিরিক্ত ৭০০ টাকা দিতে হয়েছে। প্যাকেট করার খরচও রাখছি। গ্রাহকেরা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে মাছের মূল্য পাঠান।’ সারা দেশেই তাঁর গ্রাহক আছে এবং প্রতিদিনই বিভিন্ন জেলায় মাছ পাঠান বলে জানান তিনি।
চাঁদপুর থেকে বছরে কত টাকার মাছ বিক্রি হয়—জানতে চাইলে এর সুনির্দিষ্ট উত্তর জানা নেই বলে উল্লেখ করেন জেলা মৎস্য বণিক সমিতির নেতারা। তবে তা অন্তত পাঁচ কোটি টাকা হবে বলে মনে করেন সমিতির সভাপতি আবদুল বারি মানিক জমাদার। প্রচলিত পদ্ধতির পাশাপাশি অনলাইনেও সারা দেশে মাছ, বিশেষ করে ইলিশ বিক্রির সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় এ মাছের চাহিদা বেড়েছে বলে জানান এই ব্যবসায়ী। তিনি বলেন, চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ইলিশের দামও বেড়েছে।
মানিক জমাদার বলেন, চাঁদপুর মাছঘাট প্রায় ২০০ বছরের পুরোনো। এখানে অনেকেই বাপ-দাদার আমল থেকে ইলিশের ব্যবসা করছেন। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসার ধরন পরিবর্তন হওয়ায় হাল আমলে অনেকে অনলাইনে মাছ বিক্রির দিকে মনোযোগ দিয়েছেন। এতে ইলিশের দামের ওপরও প্রভাব পড়েছে। দাম কিছুটা বেড়েছে।
তবে অনলাইনে ইলিশ বিক্রির নামে প্রতারকের সংখ্যাও বেড়েছে বলে জানান মানিক জমাদার। বলেন, ‘আমরাও অনেক অভিযোগ পেয়েছি। কিন্তু এ ব্যাপারে আমাদের তেমন কিছু করার নেই। প্রশাসন চাইলে এসব প্রতারকদের প্রযুক্তির মাধ্যমে ধরে ব্যবস্থা নিতে পারে।’
গত ২৫ সেপ্টেম্বর সকালে চাঁদপুরের ইলিশঘাটে দেখা হয় অনলাইনে মাছ বিক্রেতা জাহিদুল হাসানের সঙ্গেও। তিনি ‘ইলশে বাড়ি’ নামের একটি ফেসবুক পেজ চালান। আগের দিন তাঁর কাছে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অনলাইনে ৬০ কেজি ইলিশ কেনার অর্ডার আসে। এর মধ্যে এক কেজি বা এর বেশি ওজনের ইলিশের অর্ডার ছিল ৩০ কেজির মতো। বাকি অর্ডার এক কেজির কম ওজনের।
অনলাইনে ইলিশের বিক্রি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বিক্রেতা পরিচয়ে প্রতারকের সংখ্যাও বেড়েছে বলে জানান মানিক জমাদার। বলেন, ‘আমরাও অনেক অভিযোগ পেয়েছি। কিন্তু এ ব্যাপারে আমাদের তেমন কিছু করার নেই। প্রশাসন চাইলে এসব প্রতারকদের প্রযুক্তির মাধ্যমে ধরে ব্যবস্থা নিতে পারে।’
জাহিদুল ঘাট থেকে নিলামে এক কেজি বা এর বেশি ওজনের ইলিশ কিনেছেন ৭৫ হাজার টাকা মণ হিসেবে। সে হিসাবে প্রতি কেজি ইলিশের দাম পড়ছে ১ হাজার ৯০০ টাকা। এসব মাছ তিনি অনলাইনে বিক্রি করেছেন ১ হাজার ৯৫০ থেকে ২ হাজার ৬০০ টাকায়। গড়ে কেজিতে দাম বেড়েছে ১৭৫ টাকা। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কুরিয়ার চার্জ ও প্যাকেজিং খরচ।
জাহিদুলের কাছ থেকে সর্বনিম্ন চার কেজি মাছ কিনতে হয়। এই ৪ কেজি মাছের কুরিয়ার খরচ ৫০০ টাকা, প্যাকেজিং খরচ ২৫০। এতে অনলাইনে মাছ কিনতে গিয়ে খরচ পড়ছে বেশি।
এই মাছ ব্যবসায়ী প্রথম আলোকে বলেন, চাঁদপুরে সরাসরি জেলেদের কাছ থেকে ইলিশ কেনার সুযোগ নেই। কেননা, মৌসুমের আগেই আড়তদারদের কাছ থেকে দাদন (ঋণের আঞ্চলিক নাম) নিয়ে চুক্তিবদ্ধ হয়ে পড়েন জেলেরা। এ চুক্তি অনুসারে মৌসুমে ধরা সব মাছই আড়তদারদের কাছে বিক্রি করে দিতে হয়। দামের বৃদ্ধির শুরু সেখান থেকেই।