একমাত্র ছেলের মৃত্যুর খবর কিছুতেই মানতে পারছেন না বীর মুক্তিযোদ্ধা বাবা সুশীল কুমার ঘরামী। গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় সংঘর্ষে খুলনায় পুলিশ কনস্টেবল সুমন কুমার ঘরামীর মৃত্যু হলেও আজ শনিবার দুপুর পর্যন্ত অসুস্থ বাবাকে তা জানানো হয়নি। দুপুরের পর ছেলের মৃত্যুর খবর পেয়ে চিৎকার করে ওঠেন সুশীল ঘরামী।
সুশীল কুমার ঘরামী বলতে থাকেন, ‘ও বাবা, বাবারে এ কি শুনাইলা তোমরা, আমার বাবারে কে মারল। ভগবান, তুমি আমারে নিলা না কেন? আমারেও নিয়ে যাও, ও বাবা, তুই নাকি বাড়ি আসছিস, এ কী শুনাইল এরা…।’ এরপর নির্বাক হয়ে যান তিনি। তখন পাশে ছেলের ছবি বুকে নিয়ে বিলাপ করছিলেন মা গীতা রানী। পাশে বসে তাঁদের সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন প্রতিবেশী ও স্বজনেরা।
বাগেরহাটের কচুয়া উপজেলার কিসমত মালিপাটন গ্রামের হরি মন্দিরের পেছনে সুমনদের বাড়ি। দুপুরের পর তাঁর বাবাকে মৃত্যুর খবর জানানোর আগে অসুস্থ সুশীল ঘরামীর জন্য চিকিৎসক ও অক্সিজেন সিলিন্ডার আনা হয়। এরপর বীর নিবাসের সামনের উঠানে নিহত সুমনকে সমাহিত করার জন্য মাটি খোঁড়ার কাজ শুরু হয়।
বিকেল ৫টা ২০ মিনিটের দিকে কিসমত মালিপাটন গ্রামে সুমনের লাশ পৌঁছায়। এ সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন স্বজনেরা। অ্যাম্বুলেন্স থেকে লাশ নামানোর পর মন্দিরের সামনে ফাঁকা জায়গায় তাঁকে গার্ড অব অনার দেয় পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসন। পরে নিজ বাড়ির উঠানে তাঁকে সমাহিত করা হয়। এ সময় বাগেরহাটের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) মো. মাসুদ রানা, কচুয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মেহেদী হাসান বাবু, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রাখী ব্যানার্জি, কচুয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহসিন হোসেন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
প্রতিবেশীরা বলেন, সুমনের বাবার তিনবার স্ট্রোক হয়েছে। শারীরিকভাবে তিনি সুস্থ নন। হঠাৎ ছেলের মৃত্যুর খবর শুনলে একটা দুর্ঘটনা না ঘটে, তাই একটু সতর্কতার সঙ্গে সময় নিয়ে তাঁকে জানানো হয়। সুমনের মা গীতা রানী বিলাপ করতে করতে বলেন, ‘এত ছবি তুলে কী হবে, আমার ছেলেকে কি ফিরিয়ে দিতে পারবা।’ তখন ঘরের মেঝেতে লুটিয়ে কান্না করছিলেন সুমনের একমাত্র বোন সুমনা ঘরামী। বলছিলেন, ‘কারা মারল আমার ভাইকে। একটু কি মায়া নেই তাদের। আমাদের পরিবারকে ধ্বংস করে দিল।’
এদিকে গতকাল সকাল থেকে বৃষ্টি উপেক্ষা করে আত্মীয়স্বজন ও গ্রামবাসী স্থানীয় হরি মন্দিরের সামনে অপেক্ষায় ছিলেন সবার প্রিয় সুমনের জন্য। এই মন্দিরের পেছনেই পুলিশ কনস্টেবল সুমনের ঘরে। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বীর নিবাসের ঘর পেয়েছেন তাঁরা।
প্রতিবেশী ও সুমনের বন্ধু সমর কৃষ্ণ ঘরামী বলেন, ‘আমরা একসঙ্গে এসএসসি পাস করেছি। এরপর সে পিরোজপুরের বিএম কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে। এর কিছুদিন পর পুলিশে যোগ দেয়।’
নিহত সুমন তাঁর স্ত্রী ও একমাত্র মেয়ে স্নিগ্ধা ঘরামীকে নিয়ে খুলনার পূজাখোলা এলাকায় ভাড়া বাড়িতে থাকতেন। তিনি খুলনা মহানগর পুলিশের সহকারী পুলিশ কমিশনারের (সোনাডাঙ্গা জোন) দেহরক্ষী ছিলেন। খুলনায় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের মধ্যে গল্লামারী মোহাম্মদনগর এলাকায় ওই পুলিশ সদস্যকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। পুলিশ ছাড়াও সংঘর্ষের ঘটনায় ছাত্রসহ বহু মানুষ এখন চিকিৎসাধীন খুলনার বিভিন্ন হাসপাতালে। এ ঘটনায় লবণচরা থানার উপপরিদর্শক মোস্তফা সাকলাইন বাদী হয়ে একটি মামলা করেছেন। মামলায় অজ্ঞাতনামা ১ হাজার ২০০ জনকে আসামি করা হয়েছে।
আজ ময়নাতদন্ত শেষে বেলা তিনটার দিকে নিহত পুলিশ সদস্য সুমন কুমার ঘরামীর লাশ বয়রায় কেএমপির পুলিশ লাইনসে নেওয়া হয়। সেখানে রাষ্ট্রীয় রীতিতে গার্ড অব অনার দেওয়া শেষে ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী শেষকৃত্য সম্পাদনের জন্য লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। তখন মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. মোজাম্মেল হকসহ ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা সুমন কুমার ঘরামীর কফিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করেন।
পরে পুলিশ কমিশনার সাংবাদিকদের বলেন, নিহত ব্যক্তির পরিবারকে তাৎক্ষণিক ১ লাখ টাকা এবং লাশ সৎকারে আরও ২৫ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। পুলিশ মহাপরিদর্শকের পক্ষ থেকে আট লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র ও নগদ দুই লাখ টাকা দেওয়া হবে। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে আর্থিক সাহায্য করা হবে। কেএমপি আজীবন পরিবারটির পাশে থাকবে।