গাজীপুরের দুটি ওষুধ তৈরির কারখানায় বিভিন্ন দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন শ্রমিকেরা। আজ শনিবার সকাল থেকে শ্রীপুর ও কালিয়াকৈর উপজেলায় পৃথক এ দুটি বিক্ষোভের কারণে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। কালিয়াকৈরে শ্রমিকেরা তিন ঘণ্টা পর মহাসড়ক থেকে সরে গেলেও শ্রীপুরে বিকেলেও মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ চলছে।
শ্রীপুরে ১৩ দফা দাবিতে জেনফার বাংলাদেশ লিমিটেড কারখানার শ্রমিকেরা সকাল ৯টা থেকে বিক্ষোভ শুরু করেন। এ সময় তাঁরা উপজেলার নয়নপুর এলাকায় কারখানার সামনে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করেন। বিকেল সাড়ে চারটায় সর্বশেষ খবরে জানা যায়, তখনো শ্রমিকেরা মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ চালিয়ে যাচ্ছিলেন।
স্থানীয় লোকজন জানান, সকালে কারখানাটিতে প্রতিদিনের মতো শ্রমিকেরা কাজে যোগ দিয়েছিলেন। সকাল ৯টার দিকে কারখানার ভেতর থেকে শত শত শ্রমিক বাইরে বের হয়ে আসেন। তাঁরা হাতে ব্যানার ও ফেস্টুন নিয়ে কারখানার সামনে দাঁড়ান। ১৩ দফা দাবির কথা উল্লেখ করে তাঁরা স্লোগান দিতে থাকেন।
১৩ দফা দাবির মধ্যে রয়েছে শ্রমিকদের ন্যূনতম বেতন ২০ হাজার ৫০০ টাকা এবং এই বেতনের সঙ্গে মিলিয়ে পুরোনোদের বেতন পুনর্নির্ধারণ করতে হবে। নতুন অস্থায়ী শ্রমিকদের ৬ মাসের মধ্যে স্থায়ীকরণ করতে হবে, পুরোনো অস্থায়ী শ্রমিকদের ১৫ দিনের ভেতর স্থায়ী করতে হবে। ন্যায্য দাবি আদায়ের সঙ্গে যাঁরা সম্পৃক্ত, তাঁদের কাউকে চাকরি থেকে ছাঁটাই বা বহিষ্কার করা যাবে না এবং কোনো প্রকার হয়রানি করা যাবে না। সাপ্তাহিক ছুটি দুই দিন পুনর্বহাল করতে হবে। নাইট অ্যালাউন্স ৩০০ টাকা করতে হবে। সব শ্রমিকের হাজিরা বোনাস এক হাজার টাকা নিশ্চিত করতে হবে। জমা করা ছুটির টাকা শতভাগ পরিশোধ করতে হবে। বাৎসরিক সর্বনিম্ন ২০ শতাংশ বেতন বৃদ্ধি করতে হবে। স্থায়ী নারী শ্রমিকদের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে অস্থায়ী নারী শ্রমিকদের মাতৃত্বকালীন ছয় মাস ছুটি ও বেতন–ভাতা প্রদান করতে হবে। শ্রমিকদের ভোটের মাধ্যমে শ্রমিক ইউনিয়ন গঠন করতে হবে। প্রত্যেক স্থায়ী শ্রমিকদের ২০ বছর পূর্ণ হলে কোম্পানির খরচের মাধ্যমে হজে পাঠাতে হবে। কর্মরত অবস্থায় কোনো শ্রমিক আহত হলে তাঁর চিকিৎসা বাবদ সব খরচ কোম্পানিকে বহন করতে হবে। সব অস্থায়ী শ্রমিকদের মেডিকেল ছুটি নিশ্চিত করতে হবে।
এ ছাড়া আন্দোলনকারী শ্রমিকদের হাতে থাকা ব্যানারে ওই কারখানার মানবসম্পদ বিভাগের কর্মকর্তা আজিজুল্লাহ আবেদের পদত্যাগের দাবিসংবলিত লেখা দেখা যায়।
আন্দোলনকারী শ্রমিকদের মধ্যে মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ১৩ দফা দাবি মেনে না নিলে তাঁরা বাধ্য হয়ে সড়ক অবরোধের মতো কর্মসূচি দেবেন। মো. ওমর ফারুক নামের আরেক শ্রমিক বলেন, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা আন্দোলন থেকে সরবেন না।
কারখানার কোয়ালিটি বিভাগের প্রধান মো. দুলাল দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে প্রথম আলোকে বলেন, শ্রমিকদের সঙ্গে কিছুক্ষণের মধ্যেই আলোচনায় বসা হবে। আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধান করার চেষ্টা চলছে।
অন্যদিকে, কালিয়াকৈরে ২১ দফা দাবিতে স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের শ্রমিকেরা ‘বৈষম্যবিরোধী শ্রমিক অধিকার আন্দোলন’-এর বিক্ষোভ করেছেন। সকাল সাতটার দিকে তাঁরা উপজেলার সূত্রাপুর এলাকায় ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে টায়ার ও আবর্জনায় আগুন জ্বালিয়ে অবরোধ সৃষ্টি করেন। এতে ওই মহাসড়কে প্রায় তিন ঘণ্টা যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকে।
কারখানার শ্রমিকেরা জানান, দীর্ঘদিন ধরে কারখানা কর্তৃপক্ষ তাঁদের বেতন-ভাতাসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিয়ে বৈষম্য করে আসছে। এসব বৈষম্যের প্রতিবাদে এবং ২১ দফা দাবিতে তাঁরা আন্দোলন কর্মসূচির ঘোষণা দেন। পূর্বঘোষণা অনুযায়ী, আজ ভোর থেকেই শ্রমিকেরা কাজে যোগ না দিয়ে কারখানার সামনে অবস্থান নিতে থাকেন। পরে মহাসড়কে টায়ারে আগুন জ্বালিয়ে অবরোধ সৃষ্টি করেন শ্রমিকেরা।
খবর পেয়ে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে সেনাবাহিনী ও শিল্প পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে শ্রমিকদের বুঝিয়ে মহাসড়ক থেকে সরিয়ে নিলে যানবাহন চলাচল শুরু হয়। তবে শ্রমিকেরা মহাসড়ক থেকে সরে গেলেও কারখানার সামনে বিক্ষোভ চালিয়ে যান।
শ্রমিকদের দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে অফিস চলাকালীন বা অফিসে যাতায়াতকালে যদি কোনো কর্মী দুর্ঘটনার শিকার হন, তাহলে তাঁর সম্পূর্ণ চিকিৎসার খরচ কোম্পানি বহন করবে। সঙ্গে ওই কর্মীকে কোম্পানির এককালীন আর্থিক ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে হবে। কারখানার মানবসম্পদ বিভাগের এজিএম সুরজিৎ মুখার্জি ও প্রোডাকশন সিনিয়র ম্যানেজার দিপালক কর্মকার, সিনিয়র ম্যানেজার জাহিদুর রহমান, মানবসম্পদ বিভাগের সাম্মি আক্তার ও রুহুল আমিনকে পদত্যাগ করতে হবে। ছুটির জন্য হয়রানিমূলক আচরণ বন্ধ করতে হবে। নন-ম্যানেজমেন্ট কর্মীদের সঙ্গে সর্বদা সহনশীল সদাচরণ করতে হবে। বৈষম্যবিরোধী শ্রমিক অধিকার আন্দোলনের কোনো কর্মীকে পরবর্তী সময়ে কোনো প্রকার হয়রানি বা চাকরিচ্যুত করা যাবে না। কর্মীদের সঙ্গে সিকিউরিটি গার্ডদের উত্তম আচরণ করতে হবে। প্রতি দুই বছর পরপর সব স্থায়ী কর্মীদের গ্রেড উন্নয়ন করতে হবে। মেয়েদের মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাস করতে হবে। সঙ্গে ছুটিকালে সম্পূর্ণ বেতন–ভাতা প্রদান করতে হবে।
কারখানার মানবসম্পদ বিভাগের সহকারী মহাব্যবস্থাপক (এজিএম) সুরজিৎ মুখার্জি প্রথম আলোকে বলেন, শ্রমিকদের দাবিগুলো নিয়ে আলোচনা করা হচ্ছে। আলোচনা করে তাঁদের দাবির বিষয়গুলো নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
গাজীপুর শিল্প পুলিশের পরিদর্শক নিতাই চন্দ্র সরকার বলেন, কারখানার শ্রমিকেরা ২১ দফা দাবি জানিয়ে সকাল থেকে বিক্ষোভ করছেন। শ্রমিকেরা কয়েক ঘণ্টা মহাসড়ক অবরোধ করে রাখেন। তবে সকাল ১০টার পর থেকে মহাসড়কে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে।