সারা দিন মাঠে চরে সন্ধ্যায় বাথানে জড়ো হচ্ছে গরু। গতকাল সোমবার রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে পদ্মা নদীর খারিজাগাতির চরে
সারা দিন মাঠে চরে সন্ধ্যায় বাথানে জড়ো হচ্ছে গরু। গতকাল সোমবার রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে পদ্মা নদীর খারিজাগাতির চরে

রাজশাহীর চরে শতাধিক গরুর মৃত্যু দাবি চাষিদের

২৪ জুলাই। রাজশাহীর গোদাগাড়ীর খারিজাগাতির চরে সন্ধ্যা নামছে। ফিরছে গরুর পাল। আর চাষিদের কারও হাতে ধূপ, কারও হাতে আগরবাতি। আর কেউ শুধু আগুন জ্বালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তাঁদের ভাষায়, ‘জানের বিগাড়ে গরুর ভাইরাস তাড়াতে যে যা বুইলছে, তাই কইচ্ছি।’ এই চাষিদের হিসাবমতে, এই চরের বাথানে গত দুই মাসে অজানা ভাইরাসে শতাধিক গরু মারা গেছে। গত ১৫ দিনে মারা গেছে ৫০টি গরু। বাথানের পাশেই সব মৃত গরু মাটি চাপা দেওয়া হয়েছে। এর বেশির ভাগই বাছুর।

তবে প্রাণিসম্পদ বিভাগের কাছে এই হিসাব নেই। উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার পরামর্শে স্বেচ্ছাসেবীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে চিকিৎসা দিচ্ছেন। চাষিদের অভিযোগ, চিকিৎসায় কোনো কাজই হচ্ছে না। এটা একটা ‘ভাইরাস’।

রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার দেওপাড়া ইউনিয়নের খারিজাগাতি, নিমতলা, কোমরপুর, বিজয়নগর ও শেখপুর গ্রামের মানুষ পদ্মা নদীর চরে গরু-মহিষ পালন করেন। এটিই অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষের পেশা। গোদাগাড়ী উপজেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগের তথ্যমতে, ২০২১ সালে দেওপাড়া ইউনিয়নে গরুর সংখ্যা ছিল ২১ হাজার ৭৩১টি। এর অধিকাংশই খারিজাগাতি চরে পালন করা হয়। এই সংখ্যা গত দুই বছরে আরও বেড়েছে।

সবচেয়ে বেশি গরু মারা গেছে বিজয়নগর গ্রামের চাষি আশরাফুল ইসলামের (এলাকায় বাবু নামে পরিচিত)। তাঁর ১০টি গরু মারা গেছে। উপজেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগের কাছে তাঁর একটি গরুর মৃত্যুরও খবর নেই।

গোদাগাড়ী উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা রিপা রানী বলেন, লক্ষণ না দেখে কী রোগ তা বলা যাবে না। তিনি এলাকায় গিয়েছিলেন। কোনো চাষি ‘অন দ্য স্পট’ তাঁকে অসুস্থ গরু দেখাতে পারেননি।

চাষিরা বলছেন, বেশির ভাগ গরুই মারা যাচ্ছে পদ্মা নদীর চরে। লক্ষণ বোঝার পর আর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময় পাওয়া যাচ্ছে না। গরুর জ্বর আসছে। মাংসপেশি ফুলে যাচ্ছে। ফোলা জায়গায় চাপ দিলে ‘পুড়পুড়’ শব্দ হচ্ছে। এই লক্ষণের কথা শুনে প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা বললেন, এটা বাদলা রোগের লক্ষণ। সাধারণত এ সময় গলাফোলা ও বাদলা রোগ হয়। এই রোগের টিকা দেওয়া হয়েছে।

কিন্তু চাষিরা বলছেন, টিকাতেও রক্ষা হচ্ছে না। টিকা দেওয়া গরুও মারা যাচ্ছে।

মেডিকেল টিমের সহায়তা না পেয়ে গরুর রোগ ঠেকানোর জন্য ধূপ-আগরবাতি ও জ্বরের ওষুধ সঙ্গে করে নিয়ে বেড়াচ্ছেন চাষিরা। গত সোমবার সন্ধ্যায় পদ্মা নদীর খারিজাগাতির চরে

কৃষি তথ্য সার্ভিসের (এআইএস) তথ্য বলছে, গবাদিপশুর মারাত্মক রোগগুলোর মধ্যে বাদলা বা ব্ল্যাক কোয়ার্টার (Black Quarter) অন্যতম। এ রোগে পশু মৃত্যুর হার অনেক বেশি। পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে এ মৃত্যুর হার ১০০ ভাগই। প্রতিবছর বিশেষত বর্ষার পর এ রোগের প্রকোপ বেড়ে যায় অনেকাংশে। বাংলাদেশের অনেক গরুই এ রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। এটি একটি ব্যাকটেরিয়াজনিত মারাত্মক সংক্রামক রোগ। ঘাতক এ রোগটির জন্য দায়ী ক্লসট্রিডিয়াম চোউভি (Clostridium chauvoei) নামের ব্যাকটেরিয়া। এ জীবাণু সহজেই সংক্রমিত হতে পারে।

নিমতলা গ্রাম থেকে পদ্মার একটা শাখা নৌকায় পার হলেই গোদাগাড়ী উপজেলার খারিজাগাতি মৌজা। এখানেই সব বাথান। এখানকার মাঠেই গরু আক্রান্ত হচ্ছে। নিমতলা গ্রামের আবদুল হান্নানের পাঁচটি গরুর মধ্যে দুটি মারা গেছে। রোগের লক্ষণ সম্পর্কে হান্নান বলেন, ‘গরু হাইলছে, রইয়ে থাকতে পারছে না। প্যাট চড়হে (ফুলে) যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পরেই মুখ দিয়ে ছ্যাবড়া-ট্যাবড়া বারিয়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে।’ একই গ্রামের ইয়াকুব আলী বলেন, তাঁর ৪০-৪২ হাজার টাকা দামের এঁড়ে বাছুর মাঠে চরছিল। হাঁটতে পারছে না দেখে ঘাড়ে করে নদী পার করে এনে ওষুধ খাওয়ান। তার পরদিনই মারা যায়।

নিমতলা গ্রামের রাসেল বলেন, ‘আমার গরু অসুস্থ হওয়ার পর “ডাক্তার” (স্বেচ্ছাসেবী) ইনজেকশন দিল। তারপরই প্যাট চড়হে গেল। প্যাট চড়হার ১৫ মিনিটের মধ্যেই গরু মইরে গেল।’

বাথানের পাশে মরা গরু মাটি চাপা দেওয়ার স্থান দেখাচ্ছেন এক চাষি। গত সোমবার সন্ধ্যায় পদ্মা নদীর খারিজাগাতির চরে

নিমতলা গ্রামের চাষিরা জানান, সবচেয়ে বেশি গরু মারা গেছে বিজয়নগর গ্রামের চাষি আশরাফুল ইসলামের (এলাকায় বাবু নামে পরিচিত)। তাঁর ১০টি গরু মারা গেছে। উপজেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগের কাছে তাঁর একটি গরুর মৃত্যুরও খবর নেই। উপজেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগের স্বেচ্ছাসেবী রফিকুল ইসলাম এই এলাকায় গরুর কৃত্রিম প্রজনন করান। প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার পরামর্শে গরুর চিকিৎসাও দেন। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এত গরু মারা গেলে তো আমরা খবর পেতাম।’

বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার জন্য নৌকায় নদী পার হয়ে খারিজাগাতির চরে যেতে হয়। ঠিক সন্ধ্যার সময় গরুর পাল নিয়ে মাঠ থেকে ফিরছিলেন আশরাফুল। তাঁর ১৫০টি গরু ছিল। জানতে চাইলে আশরাফুল প্রথম আলোকে বলেন, গত দুই মাসে তাঁর ১০টি গরু মারা গেছে। এর মধ্যে তিনটি বকনা ও সাতটি বাছুর। প্রতিটি বাছুরের দাম প্রায় ৫০ হাজার টাকা। বকনাগুলোর দাম আরও বেশি।

সন্ধ্যায় চাষিরা যখন ফিরছিলেন, তখন দেখা গেল তাঁদের সবার কাছেই একটা ব্যাগ। তাঁরা একে ‘লাহারির ব্যাগ’ (খাবারের ব্যাগ) বলেন। চাষি আল্লাম বলেন, ‘সবার লাহারির ব্যাগে এখন ওষুধ পাবেন। কারও কারও কাছে আগরবাতি ও ধূপ পাবেন। দেখা গেল বেশির ভাগ চাষির ব্যাগেই জ্বরের নাপা ট্যাবলেট রয়েছে। ধূপ আগরবাতিও আছে।’ আল্লাম বললেন, ‘যে যা বুইলছে, তাই করছি।’

চরে পাওয়া গেল তারা বেগম নামের এক নারী চাষিকে। তিনি বলেন, ‘এই গরুই আমহারে সম্বল, গরুই সম্পদ। আর কিছু নাই। এই গরু লিয়া আমরা বিপদে আছি।’
চিকিৎসকেরা গরু মারা যাওয়ার বিষয়টি জানেন না—এ কথা শুনে চাষিরা এই প্রতিবেদককে গরু মাটি চাপা দেওয়ার স্থানে নিয়ে গেলেন। দেখা গেল, বাথানের পাশে বিভিন্ন জায়গায় নতুন মাটি। মাটি খুঁড়ে শিয়াল মরা গরু খেয়ে ফেলেছে। সে জন্য নতুন কয়েকটি স্থানে কাঁটা দিয়ে রাখা হয়েছে।

উপজেলার রাজাবাড়ি গ্রামের চাষি আবদুর রউফ বলেন, শুধু চরেই নয়, চাষির বাড়িতেও বাছুর মারা যাচ্ছে। তিনি তৎক্ষণাৎ এমন ১০ জন চাষির নাম-ঠিকানা বলে দিলেন। তাঁর দাবি, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর থেকে শুধু পদ্মার চরেই একটা মেডিকেল টিম পাঠানো হোক।

এ ব্যাপারে রাজশাহী জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা জুলফিকার মো. আখতার হোসেন বলেন, সাধারণত স্যাঁতসেঁতে জায়গায় যে গরুগুলো ঘাস খায়, সেগুলোর বাদলা রোগ হয়। তিনি ওই এলাকায় একটি মেডিকেল টিম পাঠানোর আশ্বাস দেন।