তিস্তার পানি এভাবে উঁচু স্থানে তুলে পলিথিনের পাইপ দিয়ে দূরে সরবরাহ করে শস্য খেতে সেচ দিচ্ছেন এক কৃষক। ছবিটি রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার বিজয়বাঁধ এলাকা থেকে তোলা
তিস্তার পানি এভাবে উঁচু স্থানে তুলে পলিথিনের পাইপ দিয়ে দূরে সরবরাহ করে শস্য খেতে সেচ দিচ্ছেন এক কৃষক। ছবিটি রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার বিজয়বাঁধ এলাকা থেকে তোলা

গভীর নলকূপে পানি নেই, বোরো নিয়ে সংকটে কৃষক

করফুল দাস বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) একটি গভীর নলকূপের চালক। তাঁর নলকূপ থেকে প্রায় ২০০ বিঘা বোরো ধানের জমিতে সেচ দেওয়া যেত। পানি ওঠা কমতে থাকায় গত বছর ৮০ বিঘা পর্যন্ত সেচ দেওয়া গেছে। নওগাঁর নিয়ামতপুর উপজেলার কড়কড়িয়া গ্রামের এই নলকূপের অধীনে এবার কোনো বোরোর আবাদ হয়নি। পানির অভাবে চাষিরা শর্ষে আর গম চাষ করেছেন। করফুলও তাঁর ৯ বিঘা বর্গা জমিতে গম ও শর্ষের চাষ করেছেন।

রাজশাহী ও রংপুরের ১৬ জেলায় বিএমডিএর সেচের আওতায় বোরো ধান চাষ করেন কৃষকেরা। তবে বরেন্দ্র এলাকা হিসেবে পরিচিত রাজশাহী অঞ্চলে বিএমডিএর গভীর নলকূপগুলোতে ঠিকমতো পানি উঠছে না। সংকট আছে নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জেও। এতে বাধ্য হয়ে ধানের বদলে অন্য ফসল চাষে ঝুঁকছেন কৃষকেরা। এই তিন জেলার ২১টি ইউনিয়নে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। যেখানে একসময় ১৬০ ফুট অ্যাকুইফার (পানির জলধারক স্তর) ছিল। এখন সেটা ৬ ফুটে নেমে এসেছে বলে পানি সম্পদ পরিকল্পনা সংস্থার (ওয়ারপো) এক গবেষণায় বলা হয়েছে।

এখনো ধান রোপণ শেষ হয়নি। সেচসংকটসহ আরও কিছু কারণে ৩০০-এর কিছু বেশি গভীর নলকূপ এখন বন্ধ আছে। আর বিএমডিএর আওতাভুক্ত ৩৬ হাজার হেক্টর জমিতে এবার সেচসংকট রয়েছে।

বিএমডিএ সূত্রে জানা গেছে, তাদের তত্ত্বাবধানে ১৫ হাজার ৮২৩টি গভীর নলকূপ ও প্রায় ৮০০ লো-লিফট পাম্প রয়েছে। এর আওতায় রয়েছে ৫ লাখ ৪০ হাজার হেক্টর জমি। এর মধ্যে ৩ লাখ ১০ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো চাষ হওয়ার কথা। এখনো ধান রোপণ শেষ হয়নি। সেচসংকটসহ আরও কিছু কারণে ৩০০-এর কিছু বেশি গভীর নলকূপ এখন বন্ধ আছে। আর বিএমডিএর আওতাভুক্ত ৩৬ হাজার হেক্টর জমিতে এবার সেচসংকট রয়েছে।

বিএমডিএর নির্বাহী পরিচালক মো. আবদুর রশীদ বলেন, গত বছরের চেয়ে বোরো চাষ এবার কম হচ্ছে। তবে এখনো রোপণ শেষ হয়নি। যে জমিগুলো বোরো চাষ থেকে বাদ পড়ছে, সেই জমিতে তাঁরা পানি সাশ্রয়ী অন্য ফসল করার জন্য কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করছেন। যেসব গভীর নলকূপ থেকে আর পানি উঠছে না, সেগুলো সরিয়ে পাশে পুনরায় বসানোর চেষ্টা করছেন। নলকূপ সরিয়ে বসানোর এই ব্যবস্থাকে ‘পুনর্বাসন’ বলছে বিএমডিএ।

নওগাঁর নিয়ামতপুর উপজেলার কড়কড়িয়া গ্রাম, চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার কলেজপাড়া, রাজশাহীর তানোরের জিনারপাড়া, উচ্চাডাঙ্গা ও শিবপুর গ্রামে সাতটি নলকূপের সব কটিই প্রায় অচল পাওয়া গেল।

খাওয়ার পানিতেও টান

সেচের পানির সংকট দেখতে প্রথম আলোর এই প্রতিবেদক গত সোমবার পাঁচটি গ্রাম ঘুরে দেখেন। নওগাঁর নিয়ামতপুর উপজেলার কড়কড়িয়া গ্রাম, চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার কলেজপাড়া, রাজশাহীর তানোরের জিনারপাড়া, উচ্চাডাঙ্গা ও শিবপুর গ্রামে সাতটি নলকূপের সব কটিই প্রায় অচল পাওয়া গেল। নলকূপগুলোতে এত কম পানি ওঠে যে তা দিয়ে বোরোর আবাদ সম্ভব নয় বলে স্থানীয় কৃষকেরা জানালেন।

কলেজপাড়া গ্রামের গভীর নলকূপটিতে দুই বছর ধরে ঠিকমতো পানি উঠছে না। বাধ্য হয়ে ওই গ্রামের বাসিন্দারা বোরো ধান চাষ বন্ধ করে দিয়েছেন। গভীর নলকূপের আওতাধীন জমিতে এখন কেউ আমবাগান করেছেন, কেউ চৈতালির (চৈত্র মাসে যে ফসল ঘরে ওঠে। এই ফসল চাষে অল্প সেচ লাগে) চাষ করছেন। কথা হয় কলেজপাড়া গ্রামের গভীর নলকূপের অপারেটর শারমিন বেগমের সঙ্গে। তিনি বলেন, এই গভীর নলকূপ থেকে এখন শুধু চৈতালিতে অল্প পরিমাণে সেচ দেওয়া হয়। আর ৮০টি পরিবারকে খাওয়ার পানি সরবরাহ করা হয়। খরার সময় খাওয়ার পানিও সরবরাহ করার সম্ভব হয় না। তখন যাঁর বাড়িতে সাবমারসিবল পাম্প আছে, লোকজন সেই বাড়ি থেকে খাওয়ার পানি সংগ্রহ করেন।

ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ কমাতে হবে। এ জন্য বরেন্দ্র এলাকায় যেসব পুকুর, খাল ও খাঁড়ি রয়েছে, সেগুলো থেকে সেচের ব্যবস্থা করতে হবে। এ থেকে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ পানির চাপ কমবে।
রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরো কৌশল বিভাগের অধ্যাপক নিয়ামুল বারী

তানোরের জিনারপাড়া গ্রামে দুটি গভীর নলকূপ রয়েছে। গত সোমবার দুপুরে একটি গভীর নলকূপের অপারেটর হাসান আলীর সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, এই গভীর নলকূপের আওতায় প্রায় আড়াই শ বিঘা জমিতে চাষাবাদ করা হতো। এখন কিছু জমিতে চৈতালি আবাদ করা হয়েছে, আর বাকি সব জমি পড়ে আছে।

নওগাঁর নিয়ামতপুর উপজেলার পাঁড়ইল ইউনিয়নের বনগাঁচান্দইল গ্রামের কৃষক দ্বিজেন চন্দ্র বর্মন বলেন, বনগাঁচান্দইল মৌজায় চারটি গভীর নলকূপ রয়েছে। আগের চেয়ে পানি কম উঠছে। এ জন্য উৎপাদন খরচ বাড়ছে। আগে যেখানে ১ হাজার ৪০০ টাকার পানি লাগত, এখন সেখানে খরচ হচ্ছে ২ হাজার টাকা।

পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন পানি সম্পদ পরিকল্পনা সংস্থা (ওয়ারপো) ২০২২ সালে জরিপ করে জানায়, গভীর নলকূপের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানি তুলে সেচকাজ চালানোর ফলে বরেন্দ্র অঞ্চলে পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। প্রতিবছর যে পরিমাণ নিচে নেমে যাচ্ছে, তা আর পুনর্ভরণ হচ্ছে না। ২০২২ সালে ‘সাসটেইনিং গ্রাউন্ড ওয়াটার ইরিগেশন ফর ফুড সিকিউরিটি ইন দ্য নর্থইস্ট রিজিয়ন অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক গবেষণায়ও বলা হয়, বোরো চাষে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারের কারণে রাজশাহী, নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে পানির স্তর নামছেই। বর্ষা মৌসুমেও এ স্তর স্বাভাবিক অবস্থায় আসছে না।

নলকূপ অপারেটরদের দৌরাত্ম্য

বিএমডিএর নির্ধারিত পানির দাম দুই কিউসেক (পানি পরিমাপের একক) পাম্পের জন্য ঘণ্টায় ১২৫ টাকা এবং এক কিউসেক পাম্পের (যে পাম্পে সেকেন্ডে এক ঘনফুট পানি ওঠে) জন্য ঘণ্টায় ১১০ টাকা। নিজের সেচ কার্ড দিয়ে কৃষকের পানি নেওয়ার কথা। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, অপারেটরের নিজের কার্ড থেকেই ইচ্ছামতো দামে কৃষককে পানি নিতে হয়। নলকূপের অপারেটর রাজনৈতিকভাবে নিয়োগ পাওয়ার কারণে এর কোনো প্রতিকারও পাওয়া যায় না বলে অভিযোগ কৃষকদের।

অপারেটরদের অনিয়মের বিরুদ্ধে গত ২৯ ফেব্রুয়ারি রাজশাহীতে বাংলাদেশ কৃষক সমিতি অবস্থান কর্মসূচি পালন করে। তারা অপারেটর নিয়োগে অনিয়ম-দুর্নীতি ও সেচের জন্য কৃষক হয়রানি বন্ধের দাবি জানায়। নিয়মিত জমিতে সেচের পানি না পেয়ে দুই বছর আগে রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর দুই কৃষক বিষপানে আত্মহত্যা করেন। সেই মামলা এখনো চলছে।

পানিসংকট মোকাবিলায় করণীয় সম্পর্কে জানতে চাইলে রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরো কৌশল বিভাগের অধ্যাপক নিয়ামুল বারী প্রথম আলোকে বলেন, ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ কমাতে হবে। এ জন্য বরেন্দ্র এলাকায় যেসব পুকুর, খাল ও খাঁড়ি রয়েছে, সেগুলো থেকে সেচের ব্যবস্থা করতে হবে। এ থেকে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ পানির চাপ কমবে।