বন্ধুর গুলিতে না ফেরার দেশে জোবাইর, মা আর বোনদের আহাজারি

বুলেটের খোসা হাতে নিয়ে দেখাচ্ছেন মাবিয়া খাতুন। এই গুলি তাঁর ছেলেকে ছুড়েছে ছেলের বন্ধুরা। শনিবার দুপুরে কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার নাজিরপাড়ায়
ছবি: প্রথম আলো

কক্সবাজারের টেকনাফে পাওনা টাকা চাইতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ তরুণ মোহাম্মদ জোবাইর (২৪) মারা গেছেন। গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় উপজেলার সদর ইউনিয়নের নাজিরপাড়া এলাকায় এক বন্ধু তাঁকে গুলি করেন। পরে জোবাইরকে উদ্ধার করে টেকনাফ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়। সেখান থেকে তাঁকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়। পরে তাঁকে উন্নত চিকিৎসার চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে রাত সাড়ে ১১টার দিকে লোহাগাড়া এলাকায় পৌঁছালে তিনি মারা যান। এরপর লাশ ময়নাতদন্তের জন্য পুনরায় কক্সবাজার সদর হাসপাতালে ফেরত আনা হয়।

এ ঘটনার পর থেকে অভিযুক্ত নজিম উদ্দিন (২৪) ও তাঁর সহযোগীরা পলাতক। নিহত জোবাইর নাজিরপাড়ার আবদুল খালেক ও মাবিয়া খাতুন দম্পতির ছেলে। তাঁদের ৭ মেয়ে ও ৪ ছেলের মধ্যে জোবাইর ১০ম সন্তান। তাঁর ছোট একটি বোন রয়েছে। তাঁদের বাবা আবদুল খালেক সাত বছর আগে হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।

টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মুহাম্মদ ওসমান গণি হত্যার বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, বন্ধুর গুলিতে গুলিবিদ্ধ হয়ে মোহাম্মদ জোবাইর মারা গেছেন। এ ঘটনায় আজ শনিবার সন্ধ্যায় লাশ দাফনের পর রাতে মামলা করা হবে বলে পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন। অভিযুক্ত যে–ই হোক না কেন, তাঁকে আইনের আওতায় আনা হবে।

এলাকাবাসী ও পুলিশ সূত্র জানায়, জোবাইর ফুটবল খেলোয়াড় ছিলেন। পাশাপাশি বাড়ির কাছে একটি ছোট মুদিদোকান চালাতেন। একই এলাকার বন্ধু ও ফুটবল খেলোয়াড় নজিম উদ্দিনের কাছে ৮০০ টাকা পেতেন জোবাইর। সেই টাকা ফেরত চাইলে গতকাল সন্ধ্যায় দুই বন্ধুর মধ্যে কথা-কাটাকাটি হয়। কিছুক্ষণ পর নজিম উদ্দিন, তাঁর ভাইসহ কয়েকজন মিলে জোবাইরের বসতঘরে গিয়ে গুলি চালান। এ সময় জোবাইর ঘর থেকে বের হওয়ার সময় মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে পড়ে যান। এ সময় জোবাইরের ছোট বোন তাহেরা আক্তারের (২২) শরীরে গুলির স্প্লিন্টার লাগে। গুলির শব্দ শুনে আশপাশের লোকজন এগিয়ে এলে হামলাকারীরা পালিয়ে যান। পরে জোবাইরকে উদ্ধার করে টেকনাফ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হয়।

টেকনাফ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক খানে আলম প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল সন্ধ্যার পর কপালে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় একজনকে হাসপাতালে আনা হয়। তাঁর অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় উন্নত চিকিৎসার জন্য কক্সবাজার সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়।

নিহত জোবাইরের বোনেরা মাকে জড়িয়ে ধরে বিলাপ করছেন। শনিবার দুপুরে টেকনাফের নাজিরপাড়ায়

মা আর বোনদের মাতম

রাতে জোবাইরের মৃত্যুর খবর শোনার পর থেকে বিলাপ করে চলেছেন তাঁর মা, বোন আর ভাইয়েরা। বাড়িতে ভিড় করতে থাকেন প্রতিবেশী ও স্থানীয় লোকজন। আজ দুপুরে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে ময়নাতন্তের পর জোবাইরের মরদেহ আনা হয় গ্রামের বাড়ি নাজিরপাড়াতে। সাইরেন বাজিয়ে বাড়ির উঠানে অ্যাম্বুলেন্স ঢুকতেই মুহূর্তের মধ্যেই পাল্টে যায় পরিবেশ।

বাবার করা অসমাপ্ত সেমিপাকা দালানের (ওপরে পলিথিনের ছাউনি দেওয়া) একটি কক্ষে রাখা হয় মরদেহটি। মরদেহের পাশে বসে মাতম করতে থাকেন বোন, ভাই ও স্বজনেরা। আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে সেখানকার বাতাস। পাশের একটি কক্ষে বিলাপ করতে করতে কিছুক্ষণ পরপর অচেতন হয়ে পড়েছিলেন মা মাবিয়া খাতুন। কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফিরলে বলতে থাকেন, ‘এত মানুষ কেন আমার ঘরে? তারা কি আমার বড় ছেলের বিয়েতে এসেছেন?’ এরপর ‘ও পুত দোস্ত বড় দুশমন....’ বলে নিজের বুকে হাত চাপড়াতে থাকেন।

নিহত মোহাম্মদ জোবাইর (বাঁয়ে ) ও অভিযুক্ত নজুম উদ্দিন (ডানে)

বিলাপ করতে থাকেন সাত বোন হাসিনা বেগম, লায়লা বেগম, মর্জিনা আক্তার, রুনা আক্তার, ইয়াসমিন আক্তার, নুরুন্নাসা কলি ও তাহেরা আক্তার। সঙ্গে তাঁদের অপর তিন ভাই আবদুস সাত্তার, মো. ফাহিম ও মোহাম্মদ শাহিন। এর মধ্যে গুলির স্প্লিন্টার লেগে তাহেরা আহত হলেও তিনি তখনো কোনো চিকিৎসা নেননি।

বোনেরা প্রথম আলোকে বলেন, ইফতারের কিছুক্ষণ আগে নজিম উদ্দিন জোবাইরকে ফোন করে বলেন, ‘বন্ধু তুই কোথায়। জোবাইর বলে, আমি বাড়িতে। তুই বাড়িতে থাক, আমি আসতেছি।’ এরপর কিছুক্ষণের মধ্যে নজিম উদ্দিনসহ কয়েকজন অস্ত্রশস্ত্রসহ বাড়িতে এসে কোনো কথা ছাড়াই গুলি করেন জোবাইরকে। জোবাইরের বোন অভিযোগ করেন, স্থানীয় ইউপি সদস্য এনামুল হকের ইশারায় ও তাঁর দেওয়া অস্ত্রে তাঁদের ভাইকে হত্যা করা হয়েছে। তাঁরা ভাইয়ের হত্যার সঙ্গে জড়িত সবার ফাঁসির দাবি করেন।

স্বজনেরা জানান, জোবাইরকে হারিয়ে পাগলপ্রায় মা ও বোনেরা। গতকাল রাত থেকে মা এলোমেলো কথা বলছেন। ছেলের মরদেহ আনার খবরেও কক্ষ থেকে বের হতে পারছেন না।

বিকেলে আসরের নামাজের পর দাফনের জন্য জোবাইরের মরদেহ যখন ঘর থেকে বের করার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছিল, তখনই নিজের কক্ষ থেকে ছুটে আসেন মা মাবিয়া খাতুন। নিথর সন্তানের পাশে বসে কিছু সময় বুক চাপড়াতে থাকেন তিনি। আর বলতে থাকেন, ‘তোদের বাবা এত বড় বাড়ি কার জন্য বানাল? নিজের আর তোদের লাশ রাখার জন্য? বলেছিল ছেলের জন্য বউ নিয়ে ঘরে উঠবে। নিজেও গেল, ছেলেকেও নিয়ে গেল। কিন্তু আমাকে রেখে গেলে কার জন্য।’

জোবাইরে লাশ বাড়িতে আনার পর বাড়িতে লোকজনের ভিড়। শনিবার দুপুরে টেকনাফের নাজিরপাড়ায়

স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ছেলের বিয়ের কথা চিন্তা করে একটি বাড়ি নির্মাণ শুরু করেন আবদুল খালেক। এর মধ্যে সাত বছর আগে হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যান। পরে সংসারের খরচ জোগাতে একটি দোকান দিয়ে ব্যবসা শুরু করেন জোবাইর। সেই দোকান থেকে বাকিতে মালামাল কেনা বাবদ ৮০০ টাকা পাওনা ছিল বন্ধু নজিম উদ্দিনের কাছে। টাকা চাইলে ‘আজকে দেব, কালকে দেব’ বলে সময় পার করছিলেন। গতকাল সন্ধ্যায় নজিম উদ্দিনের কাছে পাওনা টাকা চাইতে গিয়ে কথা-কাটাকাটির জেরে নজিম উদ্দিন গুলি করেন। কপালের ওপর গুলিবিদ্ধ হয়ে জোবাইর মারা যান।

এ ব্যাপারে কথা হয় টেকনাফ সদর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মোহাম্মদ এনামুল হকের সঙ্গে। তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের ব্যাপারে তিনি দাবি করেন, তাঁর বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। এ ঘটনায় তিনি কোনোভাবে জড়িত নন।