ঘূর্ণিঝড় রিমালে চাম্বল ও কাঠবাদাম গাছ উপড়ে পড়ে বসত ঘরের ওপর। ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান পরিবারের তিন সদস্য। বরিশালের হিজলা উপজেলার বড়জালিয়া ইউনিয়নের বাউসিয়া গ্রামে
ঘূর্ণিঝড় রিমালে চাম্বল ও কাঠবাদাম গাছ উপড়ে পড়ে বসত ঘরের ওপর। ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান পরিবারের তিন সদস্য। বরিশালের হিজলা উপজেলার বড়জালিয়া ইউনিয়নের বাউসিয়া গ্রামে

ঘূর্ণিঝড় রিমাল

উপকূলে ঝড়ের চেয়ে গাছ উপড়ে জানমালের ক্ষতি বেশি

বসতঘরের আশপাশে এবং সড়ক ও মহাসড়কের পাশে রোপণ করা দুর্বল শিকড়ের গাছ উপড়ে ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণ ও সম্পদহানি বাড়াচ্ছ। ২৬ মে ঘূর্ণিঝড় রিমালে বরিশাল বিভাগে যেসব ঘর বিধ্বস্ত ও প্রাণহানি হয়েছে, তার অধিকাংশই হয়েছে গাছ উপড়ে চাপা পড়ে। একইভাবে পুরো বিভাগের বিদ্যুৎ সরবরাহ বিচ্ছিন্ন হওয়ার পেছনেও আছে গাছ উপড়ে সরবরাহ লাইনের উপরে পড়া। উপড়ে পড়া গাছের বেশির ভাগই চাম্বল, রেইনট্রি ও মেহগনি।

শুধু রিমাল নয়, ২০২২ সালে আঘাত হানা মাঝারি মাত্রার ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবেও এ অঞ্চলে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির কারণ ছিল গাছ উপড়ে ও ভেঙে পড়া।

বরিশাল বিভাগীয় বন সংরক্ষক মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ খান প্রথম আলোকে বলেন, এ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে দ্রুত বেড়ে উঠবে, এমন গাছের চারা রোপণ করার একটি প্রবণতা আছে। এতে ঝড়ে জানমালের ক্ষতি ও ভোগান্তি বহুগুণে বেড়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে চাম্বল ও রেইনট্রি গাছের গোড়া শক্ত হয় না। এ ছাড়া এসব চারা ছোট ছোট টালির মধ্যে করায় চারা লম্বা হলেও শিকড় বড় হতে পারে না। এই প্রবণতা রোধে বন বিভাগের উদ্যোগের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা সামাজিক বনায়ন কর্মসূচিতে দেশি গাছকে জনপ্রিয় করার চেষ্টা করছি। দেশি জাতের, মাঝারি আকৃতির ও শক্ত প্রজাতির গাছের চারা আমরা নিজেরা উৎপাদন করে বিতরণ করছি।’

ঘরের ওপর পড়েছে গাছ

ঘূর্ণিঝড় রিমাল আঘাত হানার পর বিভাগের ছয় জেলার ক্ষয়ক্ষতির প্রাথমিক তালিকা তৈরি করেছে বিভাগীয় প্রশাসন। ওই তালিকা অনুযায়ী, এই বিভাগের ৫ লাখ ২৮ হাজার পরিবারের প্রায় ২২ লাখ ৩৫ হাজার মানুষ সরাসরি ক্ষতির মুখে পড়েছে।

বিভাগীয় প্রশাসন প্রাথমিক ক্ষয়ক্ষতির যে বিবরণ দিয়েছে তাতে ঘূর্ণিঝড় রিমালে এবার বরিশাল বিভাগে ১৩ জন মারা গেছেন। গাছচাপা ও দেয়াল ধসে তাঁরা প্রাণ হারিয়েছেন। আর ঝড়ে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে ১৫ হাজার ৫৩১টি বসতঘর। আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৭২ হাজার ১৬৩টি ঘর।

ঘূর্ণিঝড় রিমাল আঘাত হানার পর বরিশাল বিভাগের বিভিন্ন জেলার ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা ঘুরে দেখা যায়, এবার যে সব ঘর বিধ্বস্ত হয়েছে, তার অধিকাংশ ঘরের পাশে লাগানো গাছ উপড়ে চাপা পড়ে বিধ্বস্ত হয়েছে। অপেক্ষাকৃত ছোট গাছ যেসব ঘরের ওপর পড়েছে, সে সব ঘর আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

বরিশালের হিজলা উপজেলার বড়জালিয়া ইউনিয়নের বাউসিয়া গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, ওই গ্রামে মৃত জামাল ফকিরের টিনের ঘরে ভেঙে পড়ে বিশাল এক চাম্বল ও একটি কাঠ বাদাম গাছ। এ সময় ঘরে ছিলেন জামাল ফকিরের স্ত্রী নাজমা বেগম (৫৫), তাঁর দুই ছেলে সাইমুন ও মুন্না। তবে তাঁরা ভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে যান।

নাজমা বেগম বলেন, ঝড় শুরু হলেও তাঁরা বাড়িতে ছিলেন। রাতে বৃষ্টি শুরু হয়, সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়া। মাঝরাতে কিছু বুঝে ওঠার আগেই হঠাৎ করে বিকট শব্দে একে একে দুটি গাছ ঘরের চালার ওপর উপড়ে পড়ে। আতঙ্কিত হয়ে দুই ছেলেকে নিয়ে কোনো রকমে ঘর থেকে বের হয়ে অন্যত্র আশ্রয় নেন।

ঘূর্ণিঝড় রিমালে গাছ পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত এক বাড়ি। বরিশাল সদরের চর কাউয়ার কয়লাঘাট গ্রামে

দুই সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে জেলে জসিম উদ্দীনের (৩৭) চারজনের সংসার। টানাপোড়েনের সংসার নিয়ে মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়েছিল কীর্তনখোলার পূর্ব পাড়ে চরকাউয়া ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের কয়লাঘাট এলাকায়। ঘূর্ণিঝড় রিমালের তাণ্ডবে সেই ঠাঁইটুকু হারিয়ে এখন নিঃস্ব জসিম। ঝড়ে ঘরের মাঝবরাবর গাছ পড়ে ঘরটি বিধ্বস্ত হয়েছে। এখন গৃহহীন জসিমের পরিবার। হাতে টাকা নেই। ঘরে চাল-সওদা নেই। এখন কীর্তনখোলার ঢেউয়ের মতোই নীরব কান্না তাঁর বুকে। বলেন, ‘ঘরের পাশে রোপণ করা গাছই আমার কাল হলো, আমারে নিঃস্ব করল।’

অধিকাংশ মৃত্যু গাছচাপায়

ঘূর্ণিঝড় রিমালে বরিশাল বিভাগে ১৪ জন মারা গেছেন। এর মধ্যে বরিশাল, পটুয়াখালী ও ভোলায় তিনজন করে, বরগুনায় একজন এবং পিরোজপুরে চারজনের মৃত্যু হয়েছে। ১৪ জনের ৯ জনই গাছের নিচে চাপা পড়ে মারা যান।

বরিশালের বাকেরগঞ্জে দাড়িয়াল ইউনিয়নের একজন মারা গেছেন বাজারে যাওয়ার পথে গাছের ডাল ভেঙে। ভোলায় যে তিনজন মারা গেছেন, তাদের মধ্যে দুজনের মৃত্যু হয়েছে গাছচাপায়। পটুয়াখালীতে তিনজনের দুজন গাছচাপায় মারা গেছেন। পিরোজপুরে মারা যাওয়া চারজনের মধ্যে তিনজনেরই মৃত্যু হয়েছে গাছের নিচে চাপা পড়ে। বরগুনা সদর উপজেলার আয়লা পাতাকাটা ইউনিয়নের লেমুয়া গ্রামে ঘরের ওপরে ভেঙে পড়া গাছ সরাতে গিয়ে মারা যান আবদুর রহমান বয়াতি (৫৫) নামের একজন।

২০২২ সালের ২৪ আগস্ট ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ে বরিশাল বিভাগে তিনজনের মৃত্যু হয়েছিল। তাঁরা তিনজনই মারা যান গাছ চাপায়। ওই ঝড়ে সারা দেশে ৩৫ জনের মৃত্যু হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছিল গাছচাপায়।

গাছ পড়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘ্নিত

ঘর্ণিঝড় রিমালের তাণ্ডবে বরিশাল বিভাগের পুরো বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এতে বিভাগের পাঁচটি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির আওতায় ২১ লাখ ৬৪ হাজার ৯১০ এবং পশ্চিমাঞ্চল বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থার (ওজোপাডিকো) ৩ লাখ ৪০ হাজার গ্রাহক চরম দুর্ভোগে পড়েন। টেলিযোগাযোগ ও ইন্টারনেট পরিষেবাও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ঝড়ের তিন দিন পর বরিশাল নগর ও কয়েকটি জেলা-উপজেলা সদরের বিদ্যুৎ সরবরাহ আংশিক সচল হয়। গত এক সপ্তাহেও শতভাগ সরবরাহ নিশ্চিত করা যায়নি। এখনো গ্রামের অসংখ্য গ্রাহক বিদ্যুৎবিহীন অবস্থায় আছেন। সরবরাহ ও সঞ্চালনের লাইন ও খুঁটিতে গাছ পড়ে এই অবস্থা হয়। ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং এবং এর আগের ঘূর্ণিঝড়গুলোর সময়ও পুরো বিভাগ একইভাবে ও কারণে বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল।

বরগুনার উত্তর হেউলিবুনিয়া গ্রামের আলতাফ হোসেনের ঘরের ওপর মেহগনি গাছ উপরে পড়ে। পরিবারটির এখন মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই

আবহাওয়া বিভাগ জানাচ্ছে, ২০২২ সালের ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং ছিল একটি সাধারণ মাত্রার ঘূর্ণিঝড়। ভোলায় ঝড়টি ৬২ থেকে ৮৮ কিলোমিটার বেগে আঘাত হানে। এরপর এর শক্তি আরও ক্ষয় হয়ে দেশের স্থলভাগে আঘাত হানে। কিন্তু ঝড়টিতে প্রাণহানি ছিল অপেক্ষাকৃত অনেক, ৩৫ জন। এর বড় কারণ ছিল উপড়ে পড়া গাছ।

গত ২৬ মে দিবাগত রাতে পটুয়াখালীর খেপুপাড়ায় প্রতি ঘণ্টায় ১১১ কিলোমিটার বেগে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় রিমাল। এই ঝড় সিত্রাংয়ের চেয়ে বেশি শক্তিশালী ছিল এবং স্থলভাগে এর স্থায়িত্ব ছিল এ যাৎকালের সর্বোচ্চ, ৪০ ঘণ্টা। এতে সারা দেশে ১৬ জনের মৃত্যু হয়। এ ছাড়া উপকূলীয় ও আশপাশের ১৯ জেলায় পৌনে ২ লাখ ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়। এর মধ্যে পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়েছে ৪০ হাজার ৩৩৮টি এবং আংশিক বিধ্বস্ত হয়েছে ১ লাখ ৩৩ হাজার ৫২৮টি ঘরবাড়ি। এই ঝড়ে ক্ষতি, মৃত্যু ও ভোগান্তির বড় কারণ ছিল অসংখ্য গাছ উপড়ে পড়া।

করণীয় কী

পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি বনায়ন বিভাগের অধ্যাপক আলমগীর কবির প্রথম আলোকে বলেন, বাড়ির পাশে লাগানো চাম্বল, রেইনট্রি ও মেহগনির মতো গাছের শিকড় মাটির খুব গভীরে থাকে না। তাই পানির সংস্পর্শ পেলে গোড়ার মাটি থেকে আলগা হয়ে যায়। ফলে একটু ঝড় হলেই ভেঙে পড়ে। এ অঞ্চলের বাণিজ্যিক নার্সারিগুলোতে যেসব গাছের চারা করা হয়, সেসব চারা ৫ থেকে ৬ ফুট লম্বা হলে তার প্রথম শিকড় (টাপ রুট) কেটে তারপর বহনের সুবিধার্থে মাটির ছোট টালিতে বসিয়ে বিক্রি হয়। এতে চারা রোপণ করলে মাটিতে এর শিকড় ভালোভাবে বিন্যস্ত হতে পারে না। কিন্তু বড় পলিথিনে তা করা হলে এর শিকড়গুলো স্বাধীনভাবে বেড়ে উঠতে পারে। এসব চারা মাটিতে রোপণ করলে গোড়া শক্তপোক্তভাবে মাটিতে বিন্যস্ত হতে পারে। এটা সহজে উপড়ে পড়ে না। এ ছাড়া যেসব গাছ ঘন ডালপালা দেয় এবং দ্রুত বেড়ে লম্বা হয়ে যায়, সে সব গাছ বসত ঘরের আশপাশে এমনকি সড়ক ও বাঁধের আশপাশে লাগানো বন্ধ করা উচিত।