মেঘনা থেকে পদ্মা ও শীতলক্ষ্যা হয়ে বুড়িগঙ্গা পর্যন্ত বিস্তৃত নৌপথে পণ্যবাহী নৌযানে ডাকাতি ও চাঁদাবাজির ঘটনা কয়েক মাস ধরে বাড়ছে। বিভিন্ন স্থানে নোঙর করা নৌযান থেকে দিনের বেলায় চাঁদাবাজি করছে দুর্বৃত্তরা। রাতের বেলা এসব নৌযানে হানা দিয়ে অস্ত্রের মুখে টাকা, মুঠোফোনসহ দামি জিনিসপত্র নিয়ে যাচ্ছে ডাকাতেরা। কিছু ঘটনায় মামলা হলেও বেশির ভাগ আড়ালে থেকে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন নৌযান শ্রমিকেরা।
গত চার মাসে কেবল শরীয়তপুর ও চাঁদপুরের বিভিন্ন স্থানে নৌপথে অন্তত ৩২টি ডাকাতির ঘটনার অভিযোগ করেছে দুই জেলার বাল্কহেড মালিক সমিতি। চাঁদপুর, শরীয়তপুর, মুন্সিগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জে নৌপথের বিভিন্ন স্থানে নিয়মিত চাঁদাবাজির অভিযোগ করেছেন শ্রমিকেরা
চাঁদপুর, শরীয়তপুর ও মুন্সিগঞ্জ জেলার ওপর দিয়ে মেঘনা ও পদ্মা নদী প্রবাহিত হয়েছে। এ দুই নদী দিয়ে চট্টগ্রাম এবং দক্ষিণাঞ্চলের পণ্যবাহী ও যাত্রীবাহী নৌযান ঢাকা-নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় যাতায়াত করে। নদী দুটির বিভিন্ন সীমানায় অসংখ্য চর ও ডুবোচর রয়েছে। এসব চর ও ডুবোচরে দুর্বৃত্তরা অবস্থান নিয়ে রাতে নৌযানে আক্রমণ করে। চালক ও শ্রমিকদের জিম্মি করে ডাকাতি করে।
শরীয়তপুর ও চাঁদপুরের বাল্কহেড মালিক সমিতির নেতা ও শ্রমিকেরা বলছেন, গত সেপ্টেম্বর থেকে শরীয়তপুর বাল্কহেড মালিক সমিতির অধীন থাকা ১৫টি বাল্কহেডে ডাকাতি হয়েছে। চাঁদপুর বালুবাহী নৌযান মালিক সমবায় সমিতির অধীন থাকা ১৫টি নৌযানে ডাকাতি হয়েছে। এর মধ্যে কেবল একটি ঘটনায় শরীয়তপুরের পালং মডেল থানায় জিডি করা হয়েছে।
চাঁদপুর নৌযান মালিক সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক হারুন অর রশিদ বলেন, ‘হামলাকারীরা ট্রলার ও স্পিডবোট নিয়ে জেলে সেজে এসে নৌযানগুলোতে উঠছে। আমরা হয়রানি ও পরবর্তী সময়ে হামলার ভয়ে মামলা করছি না। আমরা চাই, নৌ পুলিশ ও কোস্টগার্ড রাতে নদীতে নিরাপত্তা বাড়িয়ে দিক।’
শরীয়তপুর বাল্কহেড মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক নাসির খান বলেন, ‘ডাকাত ও দুর্বৃত্তের ভয়ে ১ ডিসেম্বর থেকে রাতে কোনো নৌযান নদীতে পাঠাচ্ছি না। যেখানে নোঙর করে রাখা হচ্ছে, সেখানেও ওই চক্র হানা দিচ্ছে।’
নারায়ণগঞ্জের ডিক্রীরচরে বালু নামিয়ে মুন্সিগঞ্জের মিরকাদিমে ফেরার পথে কাঠপট্টি এলাকায় ১২ ডিসেম্বর ১০-১২ জনের একটি ডাকাত দল আল রওজা নামের একটি বাল্কহেডে হানা দেয়। বাল্কহেডটির শ্রমিক শরিফুল ইসলাম বলেন, ডাকাতেরা শ্রমিকদের পিটিয়ে ও কুপিয়ে টাকাপয়সাসহ দামি মালামাল লুট করে।
নৌ পুলিশের চাঁদপুর অঞ্চলের পুলিশ সুপার মুশফিকুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ডাকাতি ও নৌযানে হামলার ঘটনা থামাতে এ অঞ্চলের নৌ পুলিশের নয়টি থানা ও ফাঁড়ি কাজ করছে। সম্প্রতি ডাকাতির প্রস্তুতিকালে একটি স্পিডবোট, একটি আগ্নেয়াস্ত্র ও কিছু ধারালো অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। গত কয়েক মাসে একটি ডাকাতির মামলা হয়েছে। ঘটনা ঘটার পর মামলা না করলে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।
নৌযান ঘিরে ডাকাতি ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম বন্ধে ১৭ ডিসেম্বর নৌ পুলিশ ও কোস্টগার্ডকে চিঠি দেওয়া হয়েছিল; কিন্তু কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। তারা ব্যবস্থা না নেওয়ায় চাঁদপুরে এত বড় ঘটনা ঘটেছে।সবুজ সিকদার, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ জাহাজি শ্রমিক ফেডারেশন ও নৌযান শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন
চট্টগ্রাম, মোংলা বন্দরসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে নারায়ণগঞ্জে পণ্য নিয়ে আসে জাহাজসহ বিভিন্ন ধরনের নৌযান। এ ছাড়া চাঁদপুরসহ বিভিন্ন বালুমহাল থেকে বালু বাল্কহেডযোগে (ইঞ্জিনচালিত ট্রলার) নারায়ণগঞ্জের পূর্বাচলসহ আশপাশের বিভিন্ন জেলায় নিয়ে আসা হয়। এসব পথে দেড় হাজারের বেশি মালবাহী জাহাজ এবং সহস্রাধিক বাল্কহেড চলাচল করে।
নৌযান মালিক ও শ্রমিকদের সঙ্গে কথা জানা গেছে, শীতলক্ষ্যা-ধলেশ্বরীর মোহনা, কাঁচপুর, ডেমরা, সোনারগাঁয়ের বৈদ্যেরবাজার, মেঘনার চর, কিশোরগঞ্জ, গজারিয়া, শায়েস্তা লালখাড়াবাদ, আশুগঞ্জ, ষাটনল-মোহনপুর দশআনি, মানিকগঞ্জ, মাওয়া, বাজিতপুর—এসব এলাকায় প্রায়ই মালবাহী নৌযানে ডাকাতির ঘটনা ঘটছে। এ ছাড়া চাঁদপুরে মেঘনা নদীর চরভেরবী, ষাটনল, ইলিশা, মল্লিকপুর, দড়িরচর এলাকায় সব জাহাজকে চাঁদা দিতে হয়। শরীয়তপুরের ওয়াপদা, চরআত্রা, খাজুরতলা, বাবুরচর, পাইনপাড়া এলাকায় কিছু লোক ট্রলার দিয়ে নৌযান থেকে চাঁদা আদায় করে বলে অভিযোগ রয়েছে।
নৌযান মালিক ও শ্রমিকেরা বলছেন, ট্রলার ও স্পিডবোটে করে এসে ১০ থেকে ১৫ জনের দল আগ্নেয়াস্ত্র ও ধারালো অস্ত্র নিয়ে নৌযানে হানা দেয়। কোথাও চাঁদা দিতে হয় দুই থেকে তিন হাজার টাকা। কোথাও দিতে হয় ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা। চাঁদা না পেলে তারা নৌযান শ্রমিকদের মারধর ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে রক্তাক্ত জখম করে সবকিছু লুট করে নিয়ে যায়। ডাকাতি ও চাঁদাবাজির ঘটনা বৃদ্ধি পাওয়ায় নৌযান মালিক-শ্রমিকদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
সিলেট, সুনামগঞ্জ ও ভোলার ইলিশা থেকে বাল্কহেডে করে পাথর ও বালু আনেন মুন্সিগঞ্জের সাদেক হোসেন। প্রতিবার তাঁকে বিভিন্ন স্থানে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয় বলে জানান তিনি। চাঁদা না দিলে তাঁর বাল্কহেডের শ্রমিকদের মারধর, বাল্কহেড আটকে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে কয়েকবার। সাদেক হোসেন বলেন, ছাতক, সুনামগঞ্জ, বৈদ্যেরবাজার, সারুলিয়া, মুন্সিগঞ্জের কাঠপট্টি, কালিরচর, ষোলআনি এলাকায় চাঁদা দিতে হয় তাঁদের।
এসব ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানিয়েও কোনো সুরাহা পাওয়া যায়নি বলে অভিযোগ বাংলাদেশ জাহাজি শ্রমিক ফেডারেশন ও নৌযান শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক সবুজ সিকদারের। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নৌযান ঘিরে ডাকাতি ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম বন্ধে ১৭ ডিসেম্বর নৌ পুলিশ ও কোস্টগার্ডকে চিঠি দেওয়া হয়েছিল; কিন্তু কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। তারা ব্যবস্থা না নেওয়ায় চাঁদপুরে এত বড় ঘটনা ঘটেছে বলে মনে করেন তিনি।
[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন সত্যজিৎ ঘোষ, শরীয়তপুর, মজিবুল হক, নারায়ণগঞ্জ, আলম পলাশ, চাঁদপুর ও ফয়সাল হোসেন, মুন্সিগঞ্জ]