ঢাকী নদী জোয়ারের পানিতে ভরতে শুরু করেছে। একটু একটু করে ফেঁপে উঠছে নদী। তীরে ভেঙে যাওয়া বাঁধ আটকাতে আসা শত শত মানুষ কাজের গতি আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন। দ্রুত শেষ করতে হবে বাঁধ মেরামতের কাজ। তাঁদের আগের দিনের পরিশ্রম অনেকটাই বিফলে গেছে। বাঁধ মেরামতের পর আবারও ভেঙেছে বাঁধ।
আজ বুধবার যে করেই হোক বাঁধের কাজ শেষ করতে হবে, আটকাতে হবে নোনাজল। সেই তাগিদ থেকেই বিরামহীন বাঁধ সংস্কারের কাজ করেছেন স্থানীয় লোকজন।
আজ দুপুরে বাঁধের পাশে গালে হাত দিয়ে বসেছিলেন মধ্যবয়সী এক নারী। চোখে চোখ পড়তেই নিজ থেকেই বললেন, ‘সব তো গেল, জল ঢোকাডা যদি বন্ধ হয়।’ ওই নারীর নাম সুনীতা সরদার। খুলনার দাকোপ উপজেলার বটবুনিয়া বাজারসংলগ্ন সরদারবাড়ি এলাকায় ভেঙে যাওয়া বাঁধ মেরামতের জন্য যে রিং বাঁধ দেওয়া হচ্ছে, সেটা সুনীতাদের ভিটার ওপরই নির্মাণ করা হচ্ছে। ঘূর্ণিঝড় রিমালে বাঁধ ভেঙে ঢোকা জোয়ারের পানির তোড়ে ভেসে গেছে সুনীতাদের থাকার ঘর, রান্নাঘর ও গোয়ালঘর। গোলায় সারা বছরের জন্য রাখা খোরাকের ধানও ভেসে গেছে। আর এখন বাঁধের কারণে ভিটাটুকুও হারাতে হলো। মানুষের দেওয়া খাবার খেয়ে আর স্বজনদের বাড়িতে থেকে সুনীতাদের কাটছে দুর্বিষহ দিন। সুনীতাদের মতো আরও তিনটি পরিবারের বসতভিটার ওপর দিয়ে বাঁধ দেওয়া হচ্ছে।
ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাতে সব হারানো সুনীতা সরদার বললেন, ‘আমাদের গোলা, গোয়াল, রান্নাঘর সব ভেসে গেছে। একেবারে ভিটে সমান হয়ে গেছে। মুহূর্তের মধ্যে পানি এসে ভরে গেল। চোখের সামনে দিয়ে সব ভাসিয়ে নিয়ে গেল। গোলায় ৩০ মণ ধান ছিল, সব ভেসে গেছে। তবে কপাল ভালো বাড়ি থেকে রাস্তায় উঠে একটু দূরে দাঁড়িয়েছিলাম। যদি সোজাসুজি দাঁড়াতাম, তাহলে আমিও ভেসে যেতাম।’
সুনীতার স্বামী আগে এলাকায় ভাড়ায় মোটরসাইকেলে যাত্রী পরিবহনের কাজ করতেন। আট বছর আগে মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণ (স্ট্রোক) হওয়ার পর কর্মক্ষমতা হারিয়ে এখন বাড়িতেই থাকেন। চার সদস্যের পরিবার নিয়ে এখন অথই সাগরে পড়েছেন সুনীতা।
সুনীতা বলছিলেন, কী খাবেন, কীভাবে চলবেন, ঘর-গোয়ালের কী হবে। কিছুই মাথায় আনতে পারছেন না। বসতভিটা বলেও তো আর কিছু নেই। ভিটার ওপর দিয়েই বাঁধ হচ্ছে। এর আগে নদীভাঙনের কারণে তিন দফা ঘর হারিয়েছেন। এভাবেই চলছে বছরের পর বছর। কখনো তাঁরা ক্ষতিপূরণ পাননি। যা গেছে তা তো আর ফিরে আসবে না। ভিটার ওপর দিয়ে বাঁধ গেলেও এলাকার মানুষ যেন পানির হাত থেকে বেঁচে যায়, এটাই তাঁর আশা।
সুনীতার পাশে বসে ছিলেন স্বপ্না সরদার। ঘূর্ণিঝড় রিমাল তাঁদেরও সবকিছু কেড়ে নিয়েছে। প্রায় সব হারানোর বেদনা নিয়ে নদীর দিকে তাকিয়ে স্বপ্না ফিরে গেলেন ২০-২১ বছর আগের স্মৃতিতে। স্বপ্না বললেন, ২০০৩ সালে যখন তাঁর বিয়ে হয়, তখন বাড়ি থেকে ওয়াপদা (বেড়িবাঁধ) দেখা যেত না। রাস্তার সামনে বড় চর ছিল। এরপর তাঁদের ভিটার ওপর দিয়ে আগে তিনবার বাঁধ গেছে। তখন ঘরবাড়ি চলে গেছে, তবে একটু একটু করে সময় নিয়ে গেছে। ঘর চলে যাওয়ার আগে বুঝতে পারতেন। এবার বোঝার আগেই ঘর চলে গেছে।
ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাতের দিনের কথা স্মরণ করে স্বপ্না সরদার বলেন, সকাল থেকেই গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। দুপুরে বৃষ্টি একটু বাড়ে, তখন নদীতে জোয়ার। এরপর চোখের পলকে সব ঘটে গেল। নদীতে পানি উঁচু হতে হতে বাঁধ গড়িয়ে পানি ভেতরে ঢুকল। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে সব ভাসিয়ে নিয়ে গেল। পানির এত উচ্চতা, আর এ রকম দুদিন ধরে ঝড় কোনো দিন দেখেননি।
বাঁধ ভাঙার সময় ঘর থেকে কিছু বের করতে পারেননি স্বপ্না। তখন ভেবেছিলেন আগে জীবন বাঁচুক। স্বপ্না সরদার বললেন, ঝড় তো প্রত্যেকবার হয়। কয়েক দিন আগে থেকে জানি এবারও ঝড় আসছে। দু–এক বছর ধরে ঝড়ের সময় আশ্রয়কেন্দ্রে যান। এবার সেই সুযোগ পাননি। আর ঘর থেকে কিছুই বের করতে পারেননি। চোখের পলকে সব যেন শেষ। সারা জীবন একটু একটু নানা জিনিসে সংসার গোছোনো হয়। ঘরের জিনিস বের করতেই চাইলেই তো আর সহজে বের করা যায় না। বাচ্চাকে নেবেন, নাকি ঘরের জিনিস।
সুনীতা আর স্বপ্নার সঙ্গে কথা বলার সময় নদী জোয়ারের পানিতে ভরে যায়। স্বেচ্ছাশ্রম দেওয়া মানুষেরা লোনাপানিতে ঝোড়া, কোদাল আর হাত-পা ধুয়ে বাঁধের ভালো অংশের ওপর জড়ো হচ্ছেন। জোয়ারের আগেই পানি আটকাতে পারায় কিছুটা স্বস্তি ফিরেছে। তবে আবার কখন ভেঙে যায়, সে শঙ্কাও আছে। কাজ শেষে তাঁদের পাশে হাজির হলেন স্বপ্নার স্বামী কৃষ্ণপদ সরদার। মুখে তাঁর বিষণ্নতার ছায়া। কৃষ্ণপদ সরদার বললেন, তাঁদের ভিটার ওপর দিয়ে বাঁধ যাচ্ছে। তাঁদের থাকারও জায়গা নেই। বাঁধের কারণে এবার চারটি পরিবার ভিটাহারা হয়েছেন।
সাংবাদিক এসেছেন জানতে পেরে আস্তে আস্তে বটবুনিয়া বাজারের সরদারবাড়ি–সংলগ্ন বাঁধে মানুষ জড়ো হতে থাকেন। বাঁধ নিয়ে তাঁদের ক্ষোভের শেষ নেই। সেই ক্ষোভ পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা থেকে শুরু করে জনপ্রতিনিধি, স্থানীয় নেতা—সবার ওপর। তাঁদের কথার সারমর্ম একটাই, ‘বাঁধ ভাঙার পর ত্রাণ নয়, টেকসই বাঁধ চাই।’