হেলেনা বেগমের বসতভিটায় এসে ঠেকেছে মধুমতী নদী। নদীপাড়ে বসে বসে ভাঙনের দুশ্চিন্তায় দিন কাটে পরিবারটির। সম্প্রতি নড়াইলের লোহাগড়ার রামকান্তপুর গ্রামে
হেলেনা বেগমের বসতভিটায় এসে ঠেকেছে মধুমতী নদী। নদীপাড়ে বসে বসে ভাঙনের দুশ্চিন্তায় দিন কাটে পরিবারটির। সম্প্রতি নড়াইলের লোহাগড়ার রামকান্তপুর গ্রামে

‘আমরা যে পথের ফকির হয়ে গেলাম’

চলতি বর্ষায় মধুমতী নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে হেলেনা বেগমের (৫৫) বসতভিটার বেশির ভাগ অংশ। সঙ্গে প্রায় তিন একর ফসলি জমিও। নিরুপায় হয়ে পাশেই অন্যের জমিতে দোচালা একটি ঘর তুলেছেন। আপাতত সেখানে পাঁচ সদস্যকে নিয়ে বসবাস করছে নিঃস্ব পরিবারটি। ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা করা ছাড়া আর কোনো উপায় দেখছেন না। তিনিসহ অন্য গ্রামবাসীর আশঙ্কা, ভাঙন প্রতিরোধে ব্যবস্থা না নেওয়া হলে মানচিত্র থেকে একেবারে হারিয়ে যাবে গ্রামটি।

হেলেনা বেগমের বাড়ি নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার শালনগর ইউনিয়নের রামকান্তপুর গ্রামে। চলতি বর্ষায় গ্রামটির অন্তত ১৮টি বসতবাড়ি নদীতে বিলীন হয়েছে। অন্তত দুই দশক ধরে মধুমতী নদীতে বসতভিটা ও ফসলি জমি হারিয়েছে গ্রামটির অর্ধেকেরও বেশি পরিবার। অথচ এক দশক আগেও গ্রামের কৃষিজীবী পরিবারগুলোর সংসারে অভাব এমন তীব্র ছিল না। নদীর কাছে হার মেনে এখন তাদের অসহনীয় জীবনযুদ্ধের যন্ত্রণাময় দিন কাটছে। জীবন-জীবিকার তাগিদে কেউ এখন ভ্যানচালক, কেউ আবার শ্রমজীবী।

হেলেনার কৃষিজীবী স্বামী নিজেদের জমিজমায় চাষাবাদ করে সংসার চালাতেন। তবে এখন আর সেই উপায় নেই। যেকোনো সময়ে মধুমতী গ্রাস করে নেবে হেলেনার বসতঘরের অবশিষ্ট মাটিটুকুও। নদীর পাড়ে সেই ভিটায় এক মনে বসে ছিলেন হেলেনা বেগম। বললেন, ‘ক্যাম্বায় হ্যান্নে বাঁচে থাকব? ছাওয়ালের পড়া ক্যাম্বায় চলবে? আমরা যে পথের ফকির হয়ে গেলাম!’

গ্রামটির বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখন যেখানে নদীটি বইছে, একসময় সেখানে ছিল বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ আর লোকবসতি। শালনগর ইউনিয়নের অন্যতম বড় একটি গ্রাম ছিল রামকান্তপুর। নদীভাঙনের কারণে গ্রামটিতে পরিবারের সংখ্যা অনেকাংশে কমেছে। কারও কারও পরিবার তিন থেকে চারবারও ভাঙনের কবলে পড়েছে, হারিয়েছেন ফসলি জমির সবটুকু।

যেকোনো সময় নদীতে হারিয়ে যেতে পারে গ্রামটির আরও কয়েকটি ঘর-বাড়ি।

সরেজমিন দেখা গেছে, রামকান্তপুর গ্রামের পূর্ব পাশ দিয়ে বয়ে গেছে মধুমতী নদী। এর অন্য পাড়ে পড়েছে চর।

স্থানীয় বাসিন্দা সবেজান বেগমের (৫০) বাড়িটির একেবারে আঙিনায় এসে ঠেকেছে মধুমতী। ভাঙনের ভয়ে ঘর থেকে মালামাল সরিয়েছেন, কিন্তু ঘরটি সরাননি। সবেজান বললেন, ‘রাতি ঘোম হয় না। কোনো শব্দ হলি উঠে পড়ি, নদীর কূলি আসি। কন্নে যে ঘরবাড়ি নদীতি যায়।’

প্রায় ১২ একর ফসলি জমি ছিল গ্রামটির আরেক বাসিন্দা জাকির হোসেনের (৫০)। এর পুরোটাই নদীগর্ভে। শুধু তা–ই নয়, তিনবার নদীতে গেছে পরিবারটির বসতবাড়ি। তিনি বলেন, একসময় তাঁদের বাইচের নৌকা ছিল, সংসারে জৌলুশ ছিল। আনন্দ–উল্লাসে কাটত দিন। অথচ এখন তাঁর আশ্রয়টুকুও নেই!

নদীগর্ভে বিলীন বসতভিটা ও ফসলি জমির স্থান দেখাচ্ছেন তৈয়েব শিকদার।

গ্রামটিতে তৈয়েব শিকদারের (৫৮) বসতবাড়ি ছিল ৪৫ শতাংশ জমির ওপর। নারকেল, আম, কাঁঠালসহ অন্যান্য ফলের গাছে ভরপুর ছিল উঠান-আঙিনা। এতে দিব্যি সংসারের খরচও চলে যেত। চলতি বর্ষায় বসতবাড়ি ও গাছপালা সব নদীতে বিলীন হয়েছে। আর ফসলি জমি তো কয়েক বছর আগেই হারিয়েছেন। এখন তাঁরও কোনো জায়গাজমি নেই। অন্যের জমি ইজারা নিয়ে বসবাসের দোচালা ঘর তুলেছেন। আর সংসার চালাচ্ছেন ভ্যান চালিয়ে।

গ্রামটির বাসিন্দাদের জন্য আশার কোনো কথা জানাতে পারেনি পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। পাউবো নড়াইল কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী উজ্জ্বল কুমার সেন বলেন, গত বছর থেকেই পাউবোর কাজ সীমিত হয়ে গেছে; বরাদ্দ নেই। তাই ভাঙন রোধের কোনো পরিকল্পনা বা প্রকল্প আপাতত নেওয়া হচ্ছে না।