পাঁচ বছরেও নিজস্ব ক্যাম্পাস হয়নি। সদর হাসপাতালের কোয়ার্টারেই ক্লাস হচ্ছে। বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকের সংকট আছে। তত্ত্বীয় জ্ঞান পেলেও ব্যবহারিক জ্ঞান পাচ্ছেন না শিক্ষার্থীরা।
২০১৯ সালে ৫০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু করে নেত্রকোনা মেডিকেল কলেজ। প্রতিষ্ঠার সাড়ে চার বছর পরেও কলেজের নিজস্ব ক্যাম্পাসের জায়গায়ই ঠিক হয়নি। নেই কোনো একাডেমিক ভবন বা পরীক্ষাগার। নেত্রকোনা আধুনিক সদর হাসপাতালে কয়েকটি কক্ষে চলছে শিক্ষা কার্যক্রম।
আবাসন ও শ্রেণিকক্ষ–সংকটের মতো বিষয়গুলো শিক্ষার্থীরা মেনে নিয়ে পড়াশোনা করলেও যে সংকট তাঁদের মধ্যে হতাশা তৈরি করছে, তা হলো ক্লিনিক্যাল ক্লাস (হাতে-কলমে শিক্ষা) ও বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকস্বল্পতা।
দেড় বছরের মধ্যে ১০ মাস ক্লাস হয়ে গেছে। আর আট মাস পর তাঁদের চূড়ান্ত পরীক্ষা। অথচ এখন পর্যন্ত ক্লিনিক্যাল ক্লাস তাঁদের তেমন একটা হয়নি।নাম প্রকাশ না করার শর্তে চতুর্থ পর্বে পড়া কয়েকজন শিক্ষার্থী
শিক্ষার্থীরা বলছেন, তাঁদের চতুর্থ পর্ব চলছে। বছরখানেকের মধ্যে তাঁরা ইন্টার্ন চিকিৎসক হবেন। কার্ডিওলজি, নাক কান গলা (ইএনটি), অর্থোসার্জারিসহ বিশেষায়িত চিকিৎসায় হাতে-কলমে শিক্ষার সুযোগ নেই। ক্লিনিক্যাল শিক্ষায় ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। চিকিৎসাশিক্ষা-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের আশঙ্কা, শিক্ষকের বিদ্যমান সংকট শিগগিরই দূর না হলে শিক্ষার্থীদের অনেক বিষয়ে জানার ঘাটতি নিয়েই শেষ হতে পারে পাঁচ বছরের শিক্ষাজীবন।
অর্থোসার্জারি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, চিকিৎসাশিক্ষার ৮০ ভাগই ব্যবহারিক। শিক্ষার্থীরা হাসপাতালের আলাদা আলাদা ওয়ার্ডে মানসম্মত চিকিৎসকের অধীনে ক্লিনিক্যাল ক্লাস করতে না পারলে ঘাটতি থেকেই যাবে।
কলেজ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮ সালের অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে নেত্রকোনা মেডিকেল কলেজের উদ্বোধন করেন। কলেজের সঙ্গে ৫০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল ও নার্সিং কলেজ যুক্ত রয়েছে। বর্তমানে অস্থায়ী ক্যাম্পাস হিসেবে সদর হাসপাতালের কয়েকটি কোয়ার্টার ব্যবহৃত হচ্ছে। এরপর প্রতিবছর শিক্ষার্থী ভর্তি করা হলেও নিজস্ব ক্যাম্পাস, একাডেমিক ভবন, আবাসনের জন্য এখনো জায়গা নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। নতুন এ মেডিকেল কলেজের স্থায়ী ক্যাম্পাসের জন্য জমি অধিগ্রহণ ও অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্প মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হলেও এখনো পাস হয়নি।
বর্তমানে পাঁচটি ব্যাচে মোট শিক্ষার্থী ২৩২ জন। বিপরীতে শিক্ষক আছেন ৪৪ জন। একমাত্র অধ্যাপক অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করছেন। ৬ জন সহযোগী অধ্যাপক, ১৬ জন সহকারী অধ্যাপক, বাকি সবাই প্রভাষক।
নেত্রকোনা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ শ্যামল কুমার পাল প্রথম আলোকে বলেন, কলেজের স্থায়ী ক্যাম্পাসের জায়গা নির্ধারণসহ ভৌত অবকাঠামো স্থাপনের জন্য গণপূর্ত অধিদপ্তর একটি উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) তৈরি করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডিজি কার্যালয়ে জমা দিয়েছিল। পরে সেটি আর পাস হয়নি।
মেডিকেল কলেজের জন্য সদর উপজেলার মৌজে বালি এলাকায় জায়গা নির্বাচন করে জরিপ ও নকশার কাজ করা হয়েছিল। পরে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হলেও সেটি কার্যকর হয়নি। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দ্রুত সময়ের মধ্যে মেডিকেল কলেজের স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্ধারণ করা হবে বলে জানান নেত্রকোনার জেলা প্রশাসক শাহেদ পারভেজ।
কলেজের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে কলেজে পাঁচটি ব্যাচে মোট শিক্ষার্থী ২৩২ জন। এর মধ্যে ৬৫ শতাংশই ছাত্রী। বিপরীতে শিক্ষক আছেন ৪৪ জন। একমাত্র অধ্যাপক অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করছেন। ৬ জন সহযোগী অধ্যাপক, ১৬ জন সহকারী অধ্যাপক, বাকি সবাই প্রভাষক। শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাতে প্রতি পাঁচজন শিক্ষার্থীর বিপরীতে একজন শিক্ষক থাকলেও ইএনটি, রেডিওলজি, সার্জারিসহ কয়েকটি বিভাগের শিক্ষকসংকট প্রকট। দু-একজন শিক্ষক দিয়ে এসব বিভাগে শিক্ষা কার্যক্রম চলছে।
কলেজের তিনজন সহকারী অধ্যাপক বলেন, সংকট নিয়েই যদি চলতে হয়, তবে শিক্ষার্থীদের জানায় ঘাটতি থেকে যাবে। যেমন একটি বিভাগে একজন শিক্ষক যদি থাকেন, ওই শিক্ষককেই কয়েকটি ব্যাচের তত্ত্বীয় ক্লাস, ক্লিনিক্যাল ক্লাস, আইটেম পরীক্ষা, হাসপাতালে রোগী দেখার মতো কাজগুলো করতে হচ্ছে। ফলে শিক্ষকের ওপর যেমন অতিরিক্ত চাপ পড়ছে, তেমনি শিক্ষার্থীরাও নানাভাবে বঞ্চিত হচ্ছেন।
শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা জানান, মেডিকেলে ভর্তির পর শিক্ষার্থীরা প্রথম পর্বে দেড় বছর সময়ের মধ্যে অ্যানাটমি, ফিজিওলজি ও বায়োকেমিস্ট্রি পড়েন। দ্বিতীয় পর্বে এক বছর সময়ের মধ্যে কমিউনিটি মেডিসিন ও ফরেনসিক মেডিসিন পড়েন। তৃতীয় পর্বে এক বছরের জন্য ফার্মাকোলজি, প্যাথলজি ও মাইক্রোবায়োলজি পড়েন শিক্ষার্থীরা। চতুর্থ বা চূড়ান্ত পর্বে ক্লিনিক্যাল বিষয়ে দেড় বছর পড়তে হয় তাঁদের। এই সময়ের মধ্যে মেডিসিন, কার্ডিওলজি, শিশু, বক্ষব্যাধি, সার্জারি, অর্থোসার্জারি, ইএনটি, চক্ষু, অ্যানেসথেসিয়া ও প্রসূতি বিষয় হাসপাতালে চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে ব্যবহারিক ক্লাস করতে হয়। কিন্তু ১০০ শয্যাবিশিষ্ট আধুনিক সদর হাসপাতালে প্রয়োজনীয় চিকিৎসক ও রোগী কোনোটাই নেই। হাসপাতালে পূর্ণাঙ্গ অস্ত্রোপচার কক্ষ, আইসিইউ, সিসিইউ ও এনআইসিইউর ব্যবস্থা না থাকায় রোগীর সংখ্যাও নগণ্য। ফলে শিক্ষার্থীদের ক্লিনিক্যাল ক্লাসও ব্যাহত হচ্ছে।
চতুর্থ পর্বে পড়ছেন, এমন কয়েকজন শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, দেড় বছরের মধ্যে ১০ মাস ক্লাস হয়ে গেছে। আর আট মাস পর তাঁদের চূড়ান্ত পরীক্ষা। অথচ এখন পর্যন্ত ক্লিনিক্যাল ক্লাস তাঁদের তেমন একটা হয়নি।
হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক আবু সাঈদ মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, বর্তমানে ৪৪টি পদের মধ্যে ২৫ জন চিকিৎসক কর্মরত। চক্ষু, চর্ম ও যৌন, ডেন্টালসহ কয়েকটি পদে চিকিৎসক নেই। এতে শিক্ষার্থীদের হাতে-কলমে শেখার সুযোগ খুব কম থাকছে। ভরসা শুধু বইয়ের বিদ্যায়।
সংকট থাকার কথা স্বীকার করে অধ্যক্ষ শ্যামল কুমার পাল প্রথম আলোকে বলেন, এসব বিষয়ে প্রতিনিয়ত ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিদের জানানো হচ্ছে। এত সংকটের পরও প্রতিবছর পাসের হার শতভাগ।
নির্ধারিত স্থান না থাকায় সদর হাসপাতালের অব্যবহৃত কয়েকটি ছোট কোয়ার্টার মেরামত করে নিয়েছে কলেজ কর্তৃপক্ষ। তাতে মাত্র ১৬৬ শিক্ষার্থীর থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। বাকি ৬৬ শিক্ষার্থী বাইরে থাকেন। দ্বিতীয় বর্ষের একজন শিক্ষার্থী বলেন, ‘এখানে আসলে পড়াশোনার মতো কোনো পরিবেশই এখনো গড়ে ওঠেনি। মেডিকেলের কোনো কিছুরই সুবিধা নেই। এর মধ্যে পড়াশোনা চালিয়ে নিতে হচ্ছে। এ ছাড়া উপায় কী! এখন তো আর কোথাও যেতে পারব না।’