‘আমার ছেলেডা (পারভেজ ব্যাপারী) রাজনীতি করত না, ঢাকার বাড্ডায় ফার্নিচারের দোকানে কাজ করত। গত ১৯ জুলাই রাইতে আন্দোলনের সময় ঢাহার (ঢাকার) রামপুরায় মিছিলে গেছিল। পুলিশের গুলি খাইছে হেনো (সেখানে)। দুই দিন তার কুনো খোঁজ পাই নাই। পরে তার লগের একজন বাড়িতে ফোন কইরা কইল, আমার ছেলেডা গুলি খাইয়া মরছে।’ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ছেলে নিহত হওয়ার কথা বলতে গিয়ে কোনোভাবেই কান্না চেপে রাখতে পারছিলেন না মা শামসুন্নাহার বেগম। শিশুর মতো অঝোরে কাঁদতে শুরু করেন তিনি।
গত শনিবার বিকেলে চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার ফতেপুর পূর্ব ইউনিয়নের বারহাতিয়া গ্রামের নিজ বাড়িতে বসে পারভেজের মা ও পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের।
শামসুন্নাহার বলেন, ‘(পারভেজের) লাশের খোঁজে গত ২২ জুলাই আমার স্বামী (সবুজ ব্যাপারী) ঢাকা মেডিকেলের মর্গে যান। হেনো মৃত মানুষের তালিকায় আমার ছেলের নাম দেহেন। তয় এর আগেই লাশ নিয়া দাফন করছে আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলামের লোকেরা। লাশ কোথায় দাফন অইছে জানি না। নিরীহ ছেলেডা পুলিশের গুলিতে মরল, এহন আমার সংসার চালাইবো কে? আমার তিন মাইয়ার লেহাপড়ার খরচ কে দিবো? ছেলেডার লাশটাও দেখতে পারলাম না, এই দুঃখ কীভাবে ভুলি? আমি আমার ছেলে হত্যার বিচার চাই।’
প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে পরিবারের সদস্যরা জানান, গত ১৯ জুলাই রাত ১০টায় রাজধানীর রামপুরা এলাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার মিছিলে অংশ নিয়ে পুলিশের গুলিতে ঘটনাস্থলেই নিহত হন পারভেজ (২৩)। সেখান থেকে তাঁর লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে নিয়ে যান স্থানীয় লোকজন। পরে মরদেহটি আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের কর্মীরা ঢাকার কাকরাইল কিংবা মুগদা এলাকার কবরস্থানে দাফন করেন। সুনির্দিষ্ট তথ্য না থাকায় কবরটিকে এ পর্যন্ত শনাক্ত করতে পারেননি স্বজনেরা।
তিন বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে পারভেজ ছিলেন সবার বড়। রাজধানীর বাড্ডা এলাকায় একটি আসবাবের দোকানে কর্মচারী হিসেবে কাজ করতেন। সেই সুবাদে থাকতেন উত্তর বাড্ডা এলাকার একটি ভাড়া বাসায়। কাজ করে যা পেতেন, তা দিয়েই চলত পরিবারটির সংসার খরচ। আগে লঞ্চে শ্রমিকের কাজ করতেন পারভেজের বাবা সবুজ ব্যাপারী। এখন অসুস্থ হয়ে বাসায় বেকার বসে আছেন। ছোট তিন বোনের লেখাপড়াসহ সব খরচ পারভেজকে চালাতে হতো। প্রতিবেশীরা জানান, টিনের একটি বসতঘর ছাড়া পরিবারটির আর কোনো জমিজমা নেই।
রাজনীতি না করলেও পারভেজ সচেতন ও প্রতিবাদী ছিলেন বলে জানান বাবা সবুজ ব্যাপারী। তিনি জানান, আর্থিক সমস্যার কারণে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন পারভেজ। কয়েক বছর আগে রাজধানীতে আসবাবের দোকানে কাজ নেন। ছেলে নিহত হওয়ার পর গোটা পরিবারই এখন অন্ধকারে। সংসার কীভাবে চলবে, কীভাবে মেয়েদের লেখাপড়ার খরচ জুটবে—কিছুই বুঝতে পারছেন না।
পারভেজের বাবা সবুজ ব্যাপারী জানান, আর্থিক সমস্যার কারণে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন পারভেজ। কয়েক বছর আগে রাজধানীতে আসবাবের দোকানে কাজ নেন। ছেলে নিহত হওয়ার পর গোটা পরিবারই এখন অন্ধকারে। সংসার কীভাবে চলবে, কীভাবে মেয়েদের লেখাপড়ার খরচ জুটবে—কিছুই বুঝতে পারছেন না।
এ বিষয়ে স্থানীয় ইউপি সদস্য কাজী মোস্তাক আহম্মেদ বলেন, পরিবারটি এখন খুবই অসহায়। তাদের পাশে সরকার ও বিত্তবানদের দাঁড়ানো উচিত।
পারভেজের তিন বোনের মধ্যে নূপুর আক্তার গত বছর এইচএসসি পাস করেছেন। আর ঝুমুর আক্তার ভবিষ্যতে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেবে। সেই সঙ্গে খাদিজা আক্তার পড়ছে ষষ্ঠ শ্রেণিতে। নূপুর জানান, গত ১৭ জুলাই পারভেজের সঙ্গে মুঠোফোনে তাঁদের সর্বশেষ কথা হয়। কী কথা হয়েছে, তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, তাঁরা কেমন আছেন, ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করা হয় কি না, জানতে চান পারভেজ। মাকেও শরীরের যত্ন নিতে বলেছিলেন। এরপর তাঁর আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। আক্ষেপ করে নূপুর বলেন, ‘ভাইয়ের লাশ একটু দেখতে পেলেও শান্তি পেতাম; কিন্তু তা-ও হয়নি।’
এখনো মাঝেমধ্যে মনে হয়, আমার ভাই মরে নাই। শুক্রবার আইলেই মনে অয়, এই বুঝি ভাই ঢাকা থেকে ফোন করবে।পারভেজের বোন নূপুর
কথাগুলো বলার সময়ই গলা ধরে আসছিল নূপুরের। একসময় কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। বলেন, ‘এখনো মাঝেমধ্যে মনে হয়, আমার ভাই মরে নাই। শুক্রবার আইলেই মনে অয়, এই বুঝি ভাই ঢাকা থেকে ফোন করবে।’ নূপুরের কান্না দেখে চোখের পানি আটকাতে পারলেন না পাশে দাঁড়িয়ে থাকা দুই বোন ঝুমুর ও খাদিজা। এই কান্না যেন সংক্রমিত হয়ে মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ল পারভেজের মা–বাবা ও প্রতিবেশীদের চোখে–মুখেও।