চোখেমুখে যেন ভর করেছে রাজ্যের অন্ধকার। এর মধ্যে কামাল হোসেন জানালেন, বন্যার সময় শুধু পরনের কাপড় নিয়ে সপরিবারে ঘর ছাড়তে হয়েছিল। সাময়িক ঠাঁই মিলেছিল আশ্রয়কেন্দ্রে। তবে পানি নেমে গেলে বাড়ি ফিরে দেখেন, নিজের পরম আশ্রয়স্থল ও একমাত্র ঘরটি হেলে পড়েছে। যেকোনো মুহূর্তে ভেঙে পড়তে পারে। অথচ কয়েক দিন আগেও দুই কক্ষের এই দোচালা টিনের ঘরে স্ত্রী ও চার সন্তান নিয়ে গাদাগাদি করে থাকতেন।
কামাল হোসেনের বাড়ি লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার কুশাখালী ইউনিয়নের দক্ষিণ চিলাদী গ্রামে। তিনি সংসার চালান ইটভাটায় কাজ করে। সেখানে বছরে সাধারণ ৪ থেকে ৫ মাস কাজ থাকে, বাকি সময় বেকার বসে থাকতে হয়। ‘নুন আনতে পান্তা ফুরানোর সংসারে’ বসতঘরের এমন বেহাল দশায় দিশাহারা পুরো পরিবার। আগে দুটো মোরগ ছিল। তবে বন্যার পানিতে ডুবে মারা গেছে এগুলো। এমন অবস্থায় কীভাবে নিজেদের মাথা গোঁজার ঘরটিকে আবার শক্তপোক্ত করে দাঁড় করাবেন—এমন দুশ্চিন্তা কামালের পিছু ছাড়ছে না।
কামালের বাড়ি থেকে বের হয়ে কয়েক মিনিট হাঁটলেই মেলে চিলাদী গ্রাম সড়ক। সেখানে ৭ থেকে ৮ জন নারীর ছোট্ট জমায়েত দেখা গেল। কাছাকাছি যেতেই বোঝা যায়, এ দলেরও আলোচনার বিষয় এবারের আকস্মিক বন্যা। তাঁরা জানালেন, বন্যায় তাঁদের গ্রামে প্রায় সবাই কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
তাঁদের একজন চর শাহী ইউনিয়নের শহর কসবা গ্রামের ষাটোর্ধ্ব নারী বিবি আমেনা। বানের পানি কমার খবরে আশ্রয়কেন্দ্র থেকে হাসিমুখে বাড়ি ফিরেছিলেন। কিন্তু সেই হাসি ফিকে হয়ে যায় মুহূর্তেই। সাজানো-গোছানো ঘরটার কিছুই অক্ষত নেই। আফসোস করে তিনি বলছিলেন, বালিশ, তোশক, চৌকি, ধান, চাল সবকিছুই বানের পানিতে নষ্ট হয়েছে।
লক্ষ্মীপুরে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার পর ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে ক্ষতচিহ্ন। জেলার বন্যাকবলিত পাঁচ উপজেলার অনেক বাসিন্দার বসতঘর হেলে পড়েছে, অনেকেরটা আবার পুরোপুরি ভেঙে গেছে। চলমান বন্যার গ্রাসে শেষ আশ্রয়টুকু ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় অসহায় হয়েছেন অসংখ্য মানুষ। আশ্রয়কেন্দ্রগুলো থেকে মানুষ বাড়িঘরে ফিরলেও দুর্ভোগ কাটেনি বা কমেনি। বরং এর সঙ্গে যোগ হয়েছে দুর্ভাবনা। কারও কারও ফেলে যাওয়া ঘরের প্রায় সব আসবাব নষ্ট হয়েছে। অনেকের বসতঘরের পুরোটাই পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তূপে। কোনো কোনো বানভাসি পরিবার সব হারিয়ে পথে বসার উপক্রম।
সরকারি হিসাবেও এমন তথ্য উঠে এসেছে। লক্ষ্মীপুরের ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, জেলার ৫টি উপজেলা ও ৪টি পৌরসভায় ক্ষতিগ্রস্ত বসতঘরের সংখ্যা ১৮ হাজার ৩৬৫। এগুলোর মধ্যে অধিকাংশই কাঁচা ঘর; অন্যগুলো আধা পাকা ও পাকা। এতে মোট ১২৬ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। কার্যালয়টি থেকে ত্রাণ ও পুনর্বাসন অধিদপ্তরে পাঠানো জেলার বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি ও ত্রাণ তৎপরতা-সম্পর্কিত এক প্রতিবেদনে এসব উল্লেখ করা হয়েছে।
ওই প্রতিবেদন বলা হয়েছে, জেলার পাঁচটি উপজেলায় ২ হাজার ৭৪৬ কিলোমিটার কাঁচা, পাকা ও আধা পাকা রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে ২৯৭ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। বন্যায় টাকার অঙ্কে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে রাস্তার। এ ছাড়া ১৯৬টি সেতু ও কালভার্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর মূল্য প্রায় ১৩ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা ইউনুস মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, আশ্রয়কেন্দ্র থেকে মানুষ ইতিমধ্যে বাড়ি ফিরে গেছেন। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করা হচ্ছে।