‘শুনলাম আবার নাকি রোমাল (রেমাল) নামের এক ঝড় আসটিছে আমাগের দিকে। এলাকার মেম্বার (ইউপি সদস্য) কয়ে গেল সাবধান থাকতি হবে। আমাগের আর সাবধানের কী আছে। ঝড় আসলি আর নদীর পানি বাড়লি তো বেড়িবাঁধ ভাঙবে, আর বাঁধ ভাঙলি তো ঘর সরাতি হবে। ঘর ভাঙলি যে কত কষ্ট, তা বুঝবে কিডা। প্রত্যেক বছর ভয়ে থাকি—এই বুঝি ঝড়ের সংকেত আসল। ঝড়ের সংকেত শুনলি পরানডায় বড্ড ভয়ডর লাগে, বাপু।’
স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্যের কাছে ঘূর্ণিঝড় রেমালের আগাম সতর্কসংকেত শুনে এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন খুলনার কয়রা উপজেলার মঠবাড়ি গ্রামের জিয়াউল হক। এর আগে ঘূর্ণিঝড় আইলা, আম্পান ও ইয়াসে তিনবার ঘর ভেঙে স্থানান্তরিত হয়েছেন। অনেক কষ্টে তা সামাল দিয়ে নতুন করে ঘর তুলে মঠবাড়ি গ্রামের শাকবাড়িয়া নদীর বাঁধের পাশে পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন। আবারও ঝড়ের সংকেত শুনে তিনি আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন।
২০০৯ সালের ২৫ মে ঘূর্ণিঝড় আইলায় প্রথমবার ঘরবাড়ি ও ফসলি জমি হারান জিয়াউল হক। তখন স্ত্রী সাইমা খাতুন, দেড় বছরের ছেলে জাহিদুল ও তিন বছরের মেয়ে মুসলিমাকে নিয়ে আশ্রয় নেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বাঁধের ঢালে। টানা পাঁচ বছর কাটে সেখানেই। পরে বাঁধের পাশে এক বিঘা জমি কিনে বাড়ি করেন। ২০২০ সালের ২০ মে ঘূর্ণিঝড় আম্পানে আবার নিঃস্ব হন তিনি। সেবার স্থান পরিবর্তন করে চলে যান কয়েক কিলোমিটার দূরে আরেক বাঁধের ঢালে। পরের বছরের ২১ মে বাঁধের ঢালের খুপরিঘরটিও ভেঙে যায় ইয়াস নামের আরেকটি ঘূর্ণিঝড়ে। তারপর এলাকাছাড়া হয় পরিবারটি। টানা এক বছর শহরে দিনমজুরি করে আবার ফিরে আসেন এলাকায়। নিজের জমানো টাকা ও সংস্থার ঋণে ১০ কাঠা জমি কিনে বাড়ি করেছেন। এখন পর্যন্ত সেখানেই টিকে আছেন। তবে ঘূর্ণিঝড় রেমালের সতর্কসংকেত শুনে শঙ্কা আর আতঙ্ক ভর করেছে তাঁর ওপর।
জিয়াউল হক বলেন, ‘এই মে, মানে জ্যৈষ্ঠ মাসে তিনবার নিঃস্ব হইছি। এমন পরিস্থিতির মধ্যিও এলাকায় টিকি আছি, এটাই অনেক। মেয়েকে বিয়ে দিছি, ছেলেটাকে কাজের জন্য বাইরে পাঠাইছি। এখন স্বামী-স্ত্রী দুজনে থাকি। আবার মে মাসে ঝড়ের নাম শুনতিছি আর পেছনের ঘটনাগুলি ভাবতিছি। পরানে ভয় লাগদিছে, আবার নতুন দুর্যোগে নিঃস্ব হতি হয় নাকি।’
কপোতাক্ষ নদের তীরবর্তী মদিনাবাদ গ্রামের বাসিন্দা নিরঞ্জন মণ্ডল, জাহাঙ্গীর আলম, সোহাগ হোসেনসহ কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয় আজ শনিবার সকালে। তাঁরা জানান, আগে ভরা জোয়ারেও এলাকার বেড়িবাঁধের অর্ধেক পর্যন্ত পানি থাকত। এখন বাঁধ কানায় কানায় পূর্ণ হয়। আর ঘূর্ণিঝড় হলে নদের পানি স্বাভাবিকের তুলনায় বাড়বে, তখন বাঁধ ছাপিয়ে লোকালয় লোনাপানিতে প্লাবিত হওয়ার শঙ্কা আছে। সে জন্য আপাতত বাড়িঘর রশি বেঁধে মজবুত করার চেষ্টা করছেন তাঁরা।
মদিনাবাদ গ্রামের জাহাঙ্গীর আলম বলেন, গত বছর অক্টোবর মাসে ঘূর্ণিঝড় হামুনের সতর্কসংকেত দিলে বাড়ির সামনের নিচু বাঁধের ওপর মাটির দেয়াল দেওয়া হয়েছিল। পরে পাউবোর কর্মকর্তারা সেখানে পরিদর্শন করে বাঁধ উঁচু করে মেরামতের আশ্বাস দেন। কিন্তু সেখানে আর কাজ হয়নি। এবার আরও ঝুঁকিতে আছে বাঁধটি।
আজ সকালে কয়রা আবহাওয়া কার্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. হাসানুল বান্না প্রথম আলোকে বলেন, রেমাল গভীর নিম্নচাপে আছে, এখনো ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেয়নি। তবে ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিয়ে কাল রোববার সন্ধ্যা অথবা মধ্যরাতে উপকূল অতিক্রম করার সম্ভাবনা আছে। সুন্দরবন উপকূলে ভারী বৃষ্টিও হতে পারে। সন্ধ্যায় হলে তখন নদীতে ভাটা থাকবে, উপকূলের বেড়িবাঁধ ভাঙনের ঝুঁকি কম থাকবে। তবে যদি মধ্যরাতে হয় তাহলে বিপদ বেশি। তখন নদীতে স্বাভাবিকের চেয়ে ৩ থেকে ৫ ফুট উঁচু জোয়ার হওয়ার আশঙ্কা আছে। কয়রা উপকূলীয় উপজেলা এখনো ১ নম্বর সংকেতের আওতায় আছে।
কয়রার জিয়াউল হক আর কপোতাক্ষপারের এই বাসিন্দাদের মতোই সুন্দরবন উপকূলের অসংখ্য মানুষ ঘূর্ণিঝড় রেমাল নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন। বিশেষ করে জরাজীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধ নিয়েই তাঁদের উৎকণ্ঠা বেশি। এ ছাড়া ঘূর্ণিঝড় রেমালের আতঙ্কে সুন্দরবনে মাছ শিকার ও মধু সংগ্রহ করতে যাওয়া কয়রার জেলে ও মৌয়ালরা ইতিমধ্যে মাছ ও মধু সংগ্রহ না করে নৌকা নিয়ে উপকূলে ফিরতে শুরু করেছেন। ফিরে আসা জেলেরা বলছেন, বনের মধ্যে গুমোট আবহাওয়ায় একটি গাছের পাতাও নড়ছে না, প্রচণ্ড গরম। পানি স্বাভাবিকের তুলনায় একেবারে স্থির। এসব দুর্যোগের আগাম লক্ষণ, তাই বন থেকে লোকালয়ে ফিরে এসেছেন তাঁরা।
কয়রার সুন্দরবনসংলগ্ন হরিহরপুর এলাকার জেলে মফিজুল ইসলাম বলেন, তাঁরা বন বিভাগের অনুমতি নিয়ে সুন্দরবনে ছিলেন। তবে জঙ্গলের মধ্যে এখন অসহনীয় গরম। ভাটায় পানি নামছে কম। আগাম ঘূর্ণিঝড়ের খবর পেয়ে উপকূলে ফিরে এসেছেন। যাঁরা এখনো বনে আছেন, তাঁদের কাছে ঘূর্ণিঝড়ের বার্তা পৌঁছালে তাঁরাও চলে আসবেন বলে তিনি জানান।
সুন্দরবন খুলনা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক এ জেড এম হাছানুর রহমান বলেন, ঘূর্ণিঝড় রেমালের জন্য বন বিভাগের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে তাঁদের নিজ নিজ কর্মস্থলে থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া পর্যাপ্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় খাবারসহ শুকনা খাবার মজুতের জন্য প্রতিটি টহল ফাঁড়ি ও অফিসকে বলা হয়েছে।
কয়রা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. তারিক উজ জামান জানান, সতর্কতামূলক প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলো প্রস্তুত রাখা, দুর্যোগকালীন ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের খাদ্য, পানীয়ের ব্যবস্থাসহ সামগ্রিক পরিস্থিতি মোকাবিলায় স্বেচ্ছাসেবক টিম গঠন করা হয়েছে। সুন্দরবনে অবস্থানরত জেলেরাও যেন নিরাপদে তীরে ফিরে আসেন, সে জন্য মৎস্যজীবী সমিতির সঙ্গেও যোগাযোগ করা হয়েছে।
কয়রা উপজেলার জনপ্রতিনিধি, এলাকাবাসী ও পাউবোর কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কয়রা সদর ইউনিয়ন, মহারাজপুর ইউনিয়ন, উত্তর বেদকাশি ইউনিয়ন ও মহেশ্বরীপুর ইউনিয়নের বেশ কিছু বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে নদীর পানি বাড়লে এসব এলাকার বিভিন্ন স্থানে বাঁধ উপচে লোকালয়ে পানি প্রবেশের শঙ্কা আছে।
কয়রা উপজেলার কয়েকটি এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উপজেলার কপোতাক্ষ, শাকবাড়িয়া ও কয়রা নদীর তীরবর্তী যেসব এলাকায় এখনো মজবুত বেড়িবাঁধ হয়নি, সেসব গ্রামে বসবাসকারী পরিবারগুলোর মধ্যে ঘূর্ণিঝড় নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বেশি দেখা দিয়েছে। এসব পরিবারের অধিকাংশেরই নেই দুর্যোগ-সহনীয় বাড়িঘর। উপরন্তু, ২০২০ ও ২০২১ সালের ঘূর্ণিঝড় আম্পান ও ইয়াসে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো এখনো মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি।
কাটমারচর গ্রামের সাইফুল্লাহ ঢালী (৫০) বলেন, আম্পানের সময় কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাঁদের সবকিছুই ভেসে যায় পানির তোড়ে। এক কাপড়েই স্ত্রী আর দুই সন্তানকে নিয়ে আশ্রয় হয় গ্রামের একটি স্কুল ঘরে। সেখান থেকে কপোতাক্ষের বাঁধের ঢালে। একসময় বিভিন্ন গ্রাম থেকে শতাধিক পরিবার ছিল সেখানে। অনেকেই চলে গেছে। যাওয়ার জায়গা না থাকায় পরিবার নিয়ে সেখানেই রয়ে গেছেন তিনি।
পাউবো সূত্র জানায়, ঘূর্ণিঝড় আম্পান ও ইয়াসের পর উপজেলার ২১টি জায়গায় ভেঙে যাওয়া বাঁধ মেরামত করা হয়। পাশাপাশি ২০ কিলোমিটার ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধে মাটি ও বালুর বস্তা ফেলে সংস্কার করা হয়। বর্তমানে কয়েকটি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় সংস্কারকাজ চলমান আছে।
খুলনা পাউবোর উপসহকারী প্রকৌশলী মো. মশিউল আবেদীন বলেন, ‘এ মুহূর্তে বাঁধের দুর্বল অংশে মেরামতকাজ চলমান রয়েছে। তা ছাড়া দুর্যোগে বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হলে সেখানে তাৎক্ষণিক প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে আমাদের প্রস্তুতি আছে।’