চরাঞ্চলের ইউপির কার্যালয়গুলো বেশি বেহাল। ফলে সাধারণ মানুষ নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
গাইবান্ধায় ১৩টি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) নিজস্ব কার্যালয় নেই। নেই প্রশাসনিক ভবন। ভাড়া বাড়িতে কোনোমতে পরিষদের কার্যক্রম চলছে। সেখানে ইউপি সদস্য ও সেবা নিতে আসা মানুষের বসার ব্যবস্থা নেই। এর মধ্যে ভাড়া নেওয়া চরাঞ্চলের ইউপির কার্যালয়গুলো বেশি বেহাল। ফলে সাধারণ মানুষ নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, জেলার ৭টি উপজেলায় মোট ৮১টি ইউনিয়ন রয়েছে। এর মধ্যে ৫৭টি ইউপির নিজস্ব প্রশাসনিক ভবন রয়েছে। বাকি ১৩টির নিজস্ব ভবন নেই। ছোট আকারের ভাড়া বাড়িতে এসব পরিষদের কার্যক্রম চলছে।
এর মধ্যে সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় ১৫টি ইউনিয়নের মধ্যে ২টি, গাইবান্ধা সদর উপজেলায় ১৩টি ইউনিয়নের মধ্যে ২টি, সাঘাটা উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের মধ্যে ৪টি, ফুলছড়ি উপজেলার ৭টি ইউনিয়নের মধ্যে ৩টি, পলাশবাড়ী উপজেলায় ৮টি ইউনিয়নের মধ্যে ২টির নিজস্ব কার্যালয় নেই। জায়গার অভাবে এসব ঘর নির্মাণ করা যাচ্ছে না।
বিশেষত চরাঞ্চলের ইউপির ভাড়া নেওয়া কার্যালয়গুলোর অবস্থা করুণ। গাইবান্ধা জেলা শহর থেকে প্রায় ৫৫ কিলোমিটার দূরে সুন্দরগঞ্জ উপজেলার কাপাসিয়া ইউনিয়ন। তিস্তা নদীর ওপারে চরাঞ্চলে অবস্থিত এ ইউপির অবস্থা করুণ। কার্যালয়ের জন্য ছোট্ট একটি টিনশেডের ঘর ভাড়া নেওয়া হয়েছে। মাসিক ভাড়া পাঁচ হাজার টাকা। বিদ্যুৎ বিলসহ মাসিক সাত-আট হাজার টাকা ভাড়া গুনতে হচ্ছে।
ঘরের ভেতর চেয়ারম্যান কোনোমতে বসতে পারেন। ইউপি সদস্যদের বসার ব্যবস্থা নেই। কেউ দাঁড়িয়ে, কেউ বসে মাসিক সভার কাজ সারেন। ত্রাণের মালপত্র রাখার স্থান নেই। অনেক সময় অন্যের বাড়িতে রাখতে হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ইউপি সদস্য বলেন, কার্যালয় না থাকায় দীর্ঘদিন ধরে গ্রাম আদালত পরিচালনা বন্ধ রয়েছে। চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্যরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে সালিস বৈঠক করছেন।
এ বিষয়ে কাপাসিয়া ইউপির চেয়ারম্যান মনজু মিয়া বললেন, কার্যালয় ভাড়া বাবদ সরকারি কোনো বরাদ্দ নেই। পকেটের টাকা দিয়ে ভাড়া দিতে হচ্ছে। পরিষদের জন্য জায়গা খোঁজা হয়েছে। পরিষদের নামে দানপত্র করে নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে।
ইউনিয়নটির লালচামার গ্রামের কলেজছাত্র ইমরান মাসুদ বলেন, স্থানসংকুলান না হওয়ায় ডিজিটাল কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। মানুষ বিভিন্ন সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। সেবা নিতে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। বিশেষ করে জন্মনিবন্ধন, নাগরিকত্ব সনদের ফটোকপি করে নেওয়ার জন্য বাইরের দোকান ফটোকপি করতে হচ্ছে। অথচ এগুলো পরিষদে থাকার কথা।
এদিকে পরিষদের জন্য জায়গা নির্ধারণে ইউপি চেয়ারম্যানকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানান সুন্দরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তরিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, ভবন নির্মাণের বিষয়টি জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের স্থানীয় সরকার শাখাকে অবহিত করা হয়েছে।
একই অবস্থা গাইবান্ধা সদর উপজেলার মোল্লারচর ইউনিয়নের। এটি ব্রহ্মপুত্র নদের কারণে মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন। ভাঙনকবলিত এ ইউনিয়নে প্রায় ২৩ হাজার লোকের বাস। কিন্তু পরিষদের কোনো কার্যালয় নেই। প্রায় ২৬ বছর আগে পরিষদের ভবনটি বিলীন হয়। তখন থেকে কখনো এ গ্রামে, কখনো ও গ্রামে পরিষদের অস্থায়ী কার্যালয় করে কার্যক্রম চালানো হচ্ছে।
মোল্লারচর এলাকার স্কুলছাত্র কবীর হোসেন জানায়, ‘ডিজিটাল যুগে সব সময় ফটোকপি প্রিন্ট প্রভৃতি কাজ করতে হয়। পরিষদের ভবন থাকলে আমরা হাতের কাছেই এসব সুবিধা পেতাম। কিন্তু আমাদের গ্রাম থেকে জেলা শহরে যেতে নৌকায় দুই ঘণ্টা সময় লাগে। সামান্য কাজে জেলা শহরে যেতে অনেক খরচ হচ্ছে, সময় বেশি লাগছে।’
মোল্লারচর ইউপির চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান বলেন, পরিষদের ভবন থাকলে গ্রাম আদালতের এজলাস থাকত। সেখানে ছোটখাটো বিবাদ মেটানো যেত। এখন বাড়ির উঠানে সালিস বৈঠক করা হচ্ছে। ভবন নির্মাণে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের স্থানীয় সরকার শাখাকে জানানো হয়েছে।
ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে অবস্থিত সদর উপজেলার আরেকটি ইউনিয়ন কামারজানি। এ ইউনিয়নের নিজস্ব ভবন নেই। নদের তীরে অবস্থিত একটি বিদ্যালয়ের পরিত্যক্ত একটি ভবনে কোনোমতে কার্যক্রম চলছে। কামারজানি এলাকার সংস্কৃতিকর্মী সাদ্দাম হোসেন বলেন, ইউপির ভবনে উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা, পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের মাঠকর্মীসহ বিভিন্ন দপ্তরের ইউনিয়ন পর্যায়ের প্রতিনিধিদের বসার কথা। কিন্তু ভবনের অভাবে তাঁরা বসতে পারছেন না। ফলে সাধারণ মানুষ সরকারি নানা সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
কামারজানি ইউপির চেয়ারম্যান মতিয়ার রহমান বলেন, পরিষদের জন্য জায়গা অধিগ্রহণ ও ভবন নির্মাণে প্রশাসনকে বলা হয়েছে।
ইউপির সার্বিক কার্যক্রম পরিচালনা করে গাইবান্ধা জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের স্থানীয় সরকার শাখা। এই শাখার উপপরিচালক শরিফুল ইসলাম বলেন, কয়েকটি ইউপির নিজস্ব প্রশাসনিক ভবন নির্মাণে অনুমোদনের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।
জানতে চাইলে গাইবান্ধা এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী ছাবিউল ইসলাম বলেন, ওই সব ইউপির নিজস্ব জায়গা নেই। তাই ভবন নির্মাণ করা যাচ্ছে না। যেসব ইউপির চেয়ারম্যানরা ভবন নির্মাণে জায়গা কিনে অথবা দানপত্র করে দিচ্ছেন, সেখানেই ভবন তৈরি করে দেওয়া হয়ে থাকে। দুই বছর আগে কয়েকটির প্রস্তাবও পাঠানো হয়েছে। সেগুলো অনুমোদন পাওয়া যায়নি। তবে সম্প্রতি জমি অধিগ্রহণ করে ইউপি ভবন নির্মাণের সরকারি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।