মোহাম্মদ জহিরুল হক, ফারুক মাহমুদ চৌধুরী, ফজিলাতুন নেসা ও মকসুদ হোসেন
মোহাম্মদ জহিরুল হক, ফারুক মাহমুদ চৌধুরী, ফজিলাতুন নেসা ও মকসুদ হোসেন

সমাজ ও মনের অসুখ সারাতে কাজ করতে হবে

সিলেটের কানাইঘাটে পাঁচ বছরের শিশু মুনতাহা আক্তার হত্যাকাণ্ডের ঘটনা মানুষের মনে তীব্রভাবে নাড়া দিয়েছে। মানুষের নৈতিকতা, মানবিকতাসহ সমাজের সবখানে যে পচন ধরেছে, এটাকে তারই উদাহরণ বলছেন মানুষ। এ নিয়ে প্রথম আলো কথা বলেছে সিলেটের চার বিশিষ্ট নাগরিকের সঙ্গে।

এই বিশিষ্টজনেরা বলছেন, ‘বিচারহীনতার সংস্কৃতি আমাদের রাষ্ট্রে প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। অপরাধীদের শাস্তি পাওয়া দীর্ঘায়িত হচ্ছে। অপরাধীরা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন। তবে এর পাশাপাশি সামাজিক অবক্ষয় বাড়ছে। মানুষের মনের স্বাস্থ্য ঠিকঠাক থাকছে না।’ আইনের প্রয়োগের পাশাপাশি সমাজ ও মানুষের মনের অসুখ সারাতে কাজ করার ওপর জোর দেন তাঁরা।

৩ নভেম্বর নিখোঁজ হয় মুনতাহা। ১০ নভেম্বর তার লাশ পাওয়া যায়। এ ঘটনায় শিশুটির প্রতিবেশী মা-মেয়েসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। পুলিশ জানিয়েছে, শিশুটিকে শ্বাসরোধে হত্যা করে লাশ ডোবায় লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। পরে সেখান থেকে পুকুরে ফেলার সময় হাতেনাতে ধরা পড়েন একজন।

মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটি সিলেটের উপাচার্য মোহাম্মদ জহিরুল হক বলেন, ‘আমরা গতানুগতিক নিরাপত্তা নিয়েই কেবল কাজ করে যাচ্ছি। এ দেশে মানব ও সামাজিক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ হচ্ছে না। পুলিশ, র‌্যাব ও সেনাবাহিনী দিয়ে এসব হত্যাকাণ্ড রোধ করা যাবে না। আমাদের সমাজ ও মনের অসুখ নিয়ে কাজ করতে হবে। বিগত সময়ে আমাদের দেশে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার ধ্বংস কেবল হয়নি; আমাদের সামাজিক অবক্ষয়ও চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। যার মূল্য দিতে হচ্ছে মুনতাহার মতো শিশুদের।’

সামাজিক মূল্যবোধের অভাব আর বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে মুনতাহা হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনা কিছুদিন পরপর ঘটছে বলে মনে করেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘দেখা গেল, আলোচিত একটা হত্যাকাণ্ডের রায় নিম্ন আদালত থেকে হলো, এরপর তা উচ্চ আদালতে গেলেও দিনের পর দিন সুরাহা হচ্ছে না। উচ্চ আদালতে দ্রুততার সঙ্গে যদি এসব আলোচিত ঘটনার নিষ্পত্তি করা যেত, তাহলে সমাজে একটা বার্তা যেত।’ তিনি মনে করেন, বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বের হতে পারলেই মুনতাহা হত্যার মতো ঘটনা সমাজে অনেকটা কমে যাবে।

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট ফজিলাতুন নেসা বলেন, ‘আসলে অভাব, দারিদ্র্য, দ্বন্দ্ব ও কলহপূর্ণ পারিবারিক পরিবেশ থেকেই মূলত একজন মানুষ অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠেন। মুনতাহা হত্যার ঘটনাটিও তেমনই। সজ্ঞানে সুস্থ অবস্থায় এমন ছোট একটা শিশুকে কেউ নির্মমভাবে হত্যা করতে পারেন না। পরে সেই অপরাধ ঢাকা দেওয়ার চেষ্টাও করা হয়েছে। মানুষের আচরণগত সমস্যা দূর করতে মনের স্বাস্থ্যের প্রতি নজর দেওয়া উচিত। অপরাধ কমাতে দারিদ্র্যপ্রবণ অঞ্চলগুলোয় মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া যেতে পারে। সামাজিক বৈষম্য দূর করার পাশাপাশি বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকেও বের হতে হবে।’

দুর্নীতি মুক্তকরণ বাংলাদেশ ফোরামের সাধারণ সম্পাদক মকসুদ হোসেন বলেন, ‘কেউ এভাবে একটা ছোট্ট শিশুকে হত্যা করতে পারে, এটা এখনো আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। এ ঘটনা সিলেটসহ দেশ-বিদেশের মানুষকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছে। সবাই হতবাক ও মর্মাহত। নিষ্ঠুর এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত প্রত্যেকের দ্রুত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এমন ঘটনা এড়াতে সমাজে মানবিক মূল্যবোধ জাগাতেও কাজ করতে হবে।’