পড়ালেখা ভালো লাগে না। তাই বাড়ি থেকে পালানোর সিদ্ধান্ত নেয় দুই কিশোর আল আমীন ও মাহফুজ। চট্টগ্রাম ছেড়ে বিনা নোটিশে একেবারে ঢাকায় পাড়ি জমায় তারা। চট্টগ্রামে পরিবারের সদস্যরা খুঁজতে খুঁজতে হয়রান তাদের। থানায় সাধারণ ডায়েরিও (জিডি) করা হয়। ১৩ দিন পর দুই কিশোরের একজন আল আমীনের পরিবারের কাছে অপরিচিত নম্বর থেকে একটি ফোন আসে। ফোনের অপর প্রান্ত থেকে বলা হয়, ‘আপনার ছেলে গুলিবিদ্ধ’। এরপর সেই ফোনের সূত্র ধরেই খোঁজ মেলে দুই কিশোরের।
ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র আল আমীন (১৪) এখন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের ক্যাজুয়ালটি বিভাগে চিকিৎসাধীন। ঢাকার মৌচাক এলাকায় কোটা সংস্কার আন্দোলনের মাঝখানে পড়ে ২১ জুলাই পায়ে গুলিবিদ্ধ হয় আল আমীন। তার আগে ৮ জুলাই বাড়িতে কাউকে কিছু না বলে বন্ধু মাহফুজের সঙ্গে পালিয়ে গিয়েছিল সে। গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর অ্যাম্বুলেন্সযোগে তাকে চট্টগ্রামে নিয়ে আসা হয়। একই অ্যাম্বুলেন্সে বাড়ি ফেরে অপর কিশোর মাহফুজও।
আল আমীন ও মাহফুজ নগরের চান্দগাঁও ইডেন স্কুল অ্যান্ড কলেজে পড়ে। তাদের বাসা নগরের বাহির সিগন্যাল এলাকায়। মাহফুজ পঞ্চম শ্রেণি থেকে এই স্কুলে পড়ছে। আল আমীন প্রথম শ্রেণি থেকে। ৮ জুলাই সকালে স্কুল ও কোচিংয়ে যাওয়ার কথা বলে বের হয়ে দুজনই আর বাসায় ফেরেনি। প্রস্তুতি হিসেবে আগে থেকেই গোপনে জামাকাপড়ও নিয়ে নেয় ব্যাগে। সঙ্গে জমানো টাকাও।
আজ বুধবার সকালে চমেক হাসপাতালের ক্যাজুয়ালটি বিভাগে গিয়ে দেখা যায়, শয্যায় আল আমীনের পাশে বসেছিলেন মা নাসিমা বেগম। পাশে দাঁড়ানো বাবা রিকশাচালক মাহবুব আলম। ছিলেন মাহফুজের মামা মো. রাসেলও।
কীভাবে দুই কিশোর পালিয়ে ঢাকায় গেল, তা জানতে চাইলে মাহফুজের মামা রাসেল এর উত্তর দেন। রাসেল বলেন, মাহফুজদের মূল বাড়ি ঢাকায় চট্টগ্রাম রোড এলাকায়। তাই সেখানে তার চেনাজানা আছে। লেখাপড়া ভালো লাগত না বলে সে জন্য আল আমীনকে সঙ্গে নিয়ে পালিয়ে যায়। এরপর ওখানে গিয়ে একটা কয়েল তৈরির কারখানায় চাকরি নেয় আল আমীন ও মাহফুজ। ৯ জুলাই থেকে চাকরি শুরু করে। তাদের কাছে কোনো ফোন ছিল না। বাড়িতে তারা কোনো খবরও দেয়নি। যে কারণে দুই পরিবারের মধ্যে উদ্বেগ–উৎকণ্ঠা দেয়।
বাড়ি থেকে পালানোর ঘটনাটি সবিস্তার আল আমীনের মুখেই শোনা গেল। হাসপাতালের শয্যায় শুয়ে আল আমীন ধীরে ধীরে বলতে থাকে, ‘পড়ালেখা ভালো লাগত না। তাই আমরা বাড়ি থেকে পালানোর সিদ্ধান্ত নিই। মাহফুজের আগে থেকেই ঢাকায় চেনাজানা ছিল। তার নানার বাড়ি নারায়ণগঞ্জ। আগের পরিকল্পনা অনুযায়ী ৮ জুলাই স্কুলের জন্য বের হই। কিন্তু স্কুলে না গিয়ে এদিক–সেদিক ঘোরাঘুরি করি। এরপর বিকেলের দিকে ঢাকার বাসে উঠি। রাত একটায় চট্টগ্রাম রোডে আমাদের নামিয়ে দেয়। এরপর মাহফুজ তার পূর্বপরিচিত একজনের সঙ্গে যোগাযোগ করে তার বাসায় ওঠে।’
আল আমীনের পায়ে এখনো গুলির চিহ্ন রয়েছে। তবে আগের চেয়ে সুস্থ বলে জানান চিকিৎসক। চমেক পুলিশ ফাঁড়ির কর্মকর্তা উপপরিদর্শক আলাউদ্দিন তালুকদার বলেন, ঢাকায় আহত হয়ে এসেছে ছেলেটি। তার পায়ে গুলি লাগে।
আল আমীনের বাবা মাহবুবের চোখেমুখে এখনো ধকলের চিহ্ন। ছেলেকে হারিয়ে কয়েকটা দিন কেটেছে দুঃস্বপ্নের মতো। শয্যার পাশে দাঁড়িয়ে সেই দিনগুলোর বর্ণনা দিতে গিয়ে মাহবুব বলেন, ‘ছেলে সন্ধ্যায় না ফেরায় তার বন্ধু মাহফুজের বাসায় খোঁজ নিই। সেও ফেরেনি জানার পর রাত দুইটায় চান্দগাঁও থানায় জিডি করি। রিকশা চালানো বন্ধ করে শুধু ছেলেকে খুঁজেছি নানা জায়গায়। পাইনি কোনোখানে। তার মা–ও ছেলের চিন্তায় নাওয়া–খাওয়া ছেড়ে দেয়।’ উৎকণ্ঠায় দিনগুলো যেন কাটছিল না। অবশেষে ২১ জুলাই রাত আটটার দিকে মাহবুবের মুঠোফোনে একটা অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন আসে। অপরিচিত কণ্ঠ জানায়, ‘আল আমীন গুলিবিদ্ধ।’
মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে মাহবুবের। পরে একই ফোনে ছেলের সঙ্গে কথা বলেন তিনি। জানতে পারেন গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরপরই ঢাকার একটা বেসরকারি হাসপাতালে তাকে চিকিৎসা দেওয়া হয়। সিদ্ধান্ত নেন ছেলেকে দ্রুত চট্টগ্রাম নিয়ে আসবেন।
কী ঘটেছিল সেদিন, কীভাবেই–বা গুলিবিদ্ধ হলো আল আমীন? জানতে চাইলে সে বলে, ‘আমরা রাতে কারখানার এক পাশে থাকতাম। আমি সেদিন কাজে যাইনি। কারণ, আমার বেতন (মজুরি) তখনও ধরা হয়নি। তাই আমি ঘুরতে ঘুরতে মৌচাক এলাকায় চলে যাই। ওই সময় পুলিশ ও আর্মি আসে। আমি একটা পেট্রলপাম্পের শৌচাগারে গিয়েছিলাম। তখন বাইরে থেকে পুলিশ বের হতে বলে। বের হওয়ার পর পুলিশ চলে যেতে বলে। দৌড়ে চলে যাওয়ার সময় পেছন থেকে কে যেন গুলি করে।’
মুঠোফোনে ছেলের অবস্থান জেনে ২১ জুলাই রাতেই মাহবুব আলম ও রাসেল একটা অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া নিয়ে রওনা হন ঢাকার উদ্দেশে। কারফিউয়ের মধ্যে পথে পথে অনেক ভয়ে ভয়ে যেতে হয় তাদের। পরদিন ভোরে আল আমীন ও মাহফুজকে নিয়ে আবার রওনা হন চট্টগ্রামে। আল আমীনকে ভর্তি করা হয় চমেক হাসপাতালে।
মাহবুব আলম বলেন, ‘আমার চারটা রিকশা ছিল। তিনটা ভাড়া দিতাম। একটা নিজে চালাতাম। ছেলেকে ঢাকা থেকে আনার জন্য ১৫ হাজার টাকায় অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করি। বিক্রি করে দিই একটা রিকশা। এ ছাড়া চিকিৎসায় অনেক টাকা খরচ হয়েছে। তারপরও ছেলেটাকে ফিরে পেলাম। সুস্থ করে ঘরে নিতে পারলেই এখন শান্তি।’