তীরবর্তী বাড়ি থেকে ধলাই নদের পানি ১০ ফুট দূরে আছে। যেকোনো সময় নদীর গর্ভে তলিয়ে যেতে পারে ঘর। গতকাল শনিবার বিকেলে তোলা
তীরবর্তী বাড়ি থেকে ধলাই নদের পানি ১০ ফুট দূরে আছে। যেকোনো সময় নদীর গর্ভে তলিয়ে যেতে পারে ঘর। গতকাল শনিবার বিকেলে তোলা

‘নদী বাড়িত আইয়া লাগি গেছে, পেছন হরার জায়গা নাই’

দিনটা যেভাবেই হোক কেটে যায়। কিন্তু রাত হলেই ভয়। কখন নদীর পানি বেড়ে যায়, কখন ঢেউয়ের তোড়ে ঘরবাড়ি ধসে নদীর গর্ভে তলিয়ে যায়। ভাঙনের এই আতঙ্কে ঘুম আসে না ধলাই নদের তীরবর্তী গ্রামের মানুষের।

ধলাই নদের অবস্থান মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার রহিমপুর ইউনিয়নের রামচন্দ্রপুরে। একটু একটু করে পাড় ভেঙে তীরবর্তী ঘরবাড়ির কাছ এসেছে নদটি। যেকোনো সময় বাড়িঘরগুলো গ্রাস করতে পারে।

গতকাল শনিবার বিকেলে ধলাই নদের রামচন্দ্রপুর সেতু থেকে সরেজমিনে ভাঙনের চিত্র দেখা গেছে। ধলাই নদের অনেক স্থানেই বাঁধের অস্তিত্ব নেই। কোথাও এক ফুট, কোথাও দুই ফুটের মতো বাঁধ আছে। পাড় ধরে পায়ে হেঁটে যাওয়ার উপায় নেই। যেকোনো মুহূর্তে পাড়ের মাটি ধসে পড়তে পারে। পাড়ের অনেকগুলো গাছ ভাঙনের কবলে নদের পানিতে তলিয়ে গেছে। কিছু গাছ ঝুলে আছে। পাড়ঘেঁষা বাড়িগুলোর কাছে চলে এসেছে ভাঙন। ভয়ের মধ্যেই লোকজন বাড়িতে বসবাস করছেন। তীরে প্রায় ১৫টি পরিবারের বাস। বংশপরম্পরায় তাঁরা এখানে বসবাস করে আসছেন। এই ভাঙনের মধ্যে আর কত দিন তাঁরা এখানে টিকতে পারবেন, কোথায় বাড়িঘর নিয়ে সরবেন—এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় তাঁরা। রামচন্দ্রপুরে প্রায় ৫০০ থেকে ৬০০ ফুট এলাকাজুড়ে বাঁধ ধসে পড়েছে।

রামচন্দ্রপুর গ্রামের মাহমুদ মিয়া বলেন, ‘অখন পেছন দিকে হরার আর জায়গা নাই। নদী বাড়িত আইয়া লাগি গেছে। অখন ব্লক দিয়া বান দিলে রক্ষা পাইতাম পারি। মাটি দিয়া বান দিলে কোনো ফায়দা অইতো নায়। ২০ বছরে দুইবার ঘর হরাইছি। অখন নদীত পানি বাড়লে ছেলেমেয়ে নিয়া হরি যাইতে অয়। নিরাপত্তা নাই। আতঙ্কের মধ্যে আছি। নদী ভাঙার পর আর ঘুম নাই।’

একই গ্রামের মশাহিদ মিয়া বলেন, ‘বাপ-দাদার আমল থাকি ইখানো আছি। অখন ঘর থাকি ১০ ফুট দূরই আছে নদী। এবার বেশি ভাঙছে। পানিয়ে বাঁধর মোর খুদিলায়। পানি বাড়ার পর যখন পানি লামতো থাকে। তখন খালি মোর ফাটা দিব আর ভাঙব।’ তিনি বলেন, ‘আবার ভাঙা দিলে ঘর যাইবোগি। ঘর ভাঙলে আর যাইবার জাগা নাই।’

ধলাই নদের পাড় ধরে পায়ে হেঁটে যাওয়ার উপায় নেই। যেকোনো মুহূর্তে পাড়ের মাটি ধসে পড়তে পারে। গতকাল শনিবার বিকেলে তোলা

পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) মৌলভীবাজার ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ধলাই একটি খরস্রোতা নদ। পানির প্রায় পুরোটাই আসে ভারত থেকে। হঠাৎ করে নদে পানি বেড়ে যায়। এক-দুই ঘণ্টায় অনেক পানি হয়ে যায় নদটিতে। স্থায়ী প্রতিরক্ষা বাঁধ নেই। পানি বেড়ে গেলে পাড় উপচে বিভিন্ন এলাকায় ঢুকে পড়ে। বিভিন্ন এলাকার ফসল, রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দুই পাড়ে বাঁধের পরিমাণ প্রায় ১০০ কিলোমিটার।

পাউবো মৌলভীবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জাবেদ ইকবাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘শুধু রামচন্দ্রপুরই নয়, ধলাই নদের বাঁধের আড়াই থেকে তিন কিলোমিটার এলাকার ভাঙন খুবই ভয়াবহ। আমরা ভাঙনকবলিত এলাকায় গিয়েছি। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে রিপোর্টও করেছি। কিন্তু ধলাইয়ে যে পরিমাণ ভাঙন আছে, তাতে অস্থায়ী প্রতিরক্ষাব্যবস্থা নিলে তিন কোটি টাকা লাগবে। পানির মধ্যে তা টেকসই হবে না। এক-দুই বছরও টিকবে না।’

একটু একটু করে পাড় ভেঙে তীরবর্তী ঘরবাড়ির কাছ এসেছে নদটি। গতকাল শনিবার বিকেলে তোলা

নির্বাহী প্রকৌশলী আরও বলেন, ‘আমরা স্থায়ীভাবে বাঁধ নির্মাণের জন্য ৮৮ কিলোমিটারের একটি প্রকল্প পানি উন্নয়ন বোর্ডে জমা দিয়েছি। এতে সম্ভাব্য খরচ ধরা হয়েছে ৫৩০ কোটি টাকা। বর্তমানে প্রকল্পটি সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের (ফিজিবিলি স্টাডি) পর্যায়ে আছে।’