ঝিকরগাছা সরকারি বহুমুখী মডেল হাইস্কুল
ঝিকরগাছা সরকারি বহুমুখী মডেল হাইস্কুল

ঝিকরগাছা মডেল হাইস্কুলে ৫ বছরে ৩১ খাতে ৭৮ লাখ টাকার অনিয়মের অভিযোগ

যশোরের ঝিকরগাছা সরকারি বহুমুখী মডেল হাইস্কুলে ভুয়া ভাউচার দেখিয়ে শিক্ষার্থীদের টিফিনের টাকা আত্মসাতের অভিযোগ পাওয়া গেছে। ‘ডাইনামিক সফটওয়্যার’ পরিচালনার নামেও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ নেওয়া হয়েছে। খরচ নেই এমন ১০টি খাতে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টাকা আদায় করা হচ্ছে। এভাবে গত ৫ বছরে বিদ্যালয়ের বিভিন্ন খাতে প্রায় ৭৮ লাখ টাকার অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে।

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোস্তাফিজুর রহমানের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে গত ১৪ আগস্ট বিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা কমিটি গঠন করা হয়। সহকারী প্রধান শিক্ষক এ এফ এম সাজ্জাদুল আলমসহ চারজন শিক্ষকের এই কমিটি তদন্তে আর্থিক অনিয়ম পেয়েছে।

বিদ্যালয়ে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রেজিস্টার খাতায় লেখা আছে, চলতি বছরের ১১ মে ৬ষ্ঠ থেকে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত ৫১৭ জন শিক্ষার্থীকে দুপুরে ১টি করে কলা ও ২টি করে পাউরুটি দেওয়া হয়। যার দাম ৪ হাজার ১৮৫ টাকা। একই দিনে তিনবার টিফিন দেওয়া দেখিয়ে ৩টি বিল-ভাউচারে ১২ হাজার ৫৮৫ টাকা খরচ দেখানো হয়েছে।

ওই তিনটি বিল-ভাউচার দেখালে ঝিকরগাছার আল আমিন বেকারি অ্যান্ড জেনারেল স্টোরের স্বত্বাধিকারী এস এম তুহিন কবির বলেন, ‘এই তিনটির মধ্যে একটি আমার লেখা ভাউচার। অপর দুটি অন্য কেউ আমাদের প্রতিষ্ঠানের প্যাড ফটোকপি করে ভাউচার বানিয়ে নিতে পারে।’

২৯ আগস্ট নিরীক্ষা কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের জুলাই পর্যন্ত ১ বছরে বিদ্যালয়ে ৬ লাখ ৪৮ হাজার ৬৯৩ টাকার টিফিন দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ২ লাখ ৬৩ হাজার টাকার আপত্তি রয়েছে।

এ বিষয়ে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমাদের ভুল হয়েছে। এটা তো হওয়ার কথা নয়। কীভাবে হলো বুঝতে পারছি না। নিশ্চয়ই আমাদের কোথাও ভুল হয়েছে।’

সহকারী প্রধান শিক্ষক সাজ্জাদুল আলম বলেন, ‘আমরা চারজন শিক্ষক খাতাপত্র, বিল-ভাউচার যাচাই করে দেখেছি। ২০১৮ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ৪ বছরে মোট ৭৮ লাখ ৬৫ হাজার ৪৮৭ টাকার অসংগতি পেয়েছি। এখন ইচ্ছা করলে কোনো সরকারি সংস্থার মাধ্যমে উচ্চতর কমিটি গঠন করে পুনঃতদন্ত করা যেতে পারে।’

এদিকে প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়ে মাসকুরা খাতুন নামের একজন অভিভাবক ৯ আগস্ট জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মাসুমা আখতারকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে প্রশাসন। তদন্ত কার্যক্রম এখনো চলমান।

অভিভাবক মাসকুরা খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সিল-স্বাক্ষর ছাড়াই ‘বেতন আদায় কার্ডের’র মাধ্যমে অস্তিত্বহীন বিভিন্ন খাতে টাকা আদায় করছে। যে কারণে অভিভাবকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

অস্তিত্বহীন খাতে টাকা আদায়

সরকারি এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ২০টি খাতে প্রতিবছর শিক্ষার্থীপ্রতি ১ হাজার ৮৯৬ টাকা নেওয়া হয়। এর মধ্যে ১০টি খাতে কোনো খরচ হয় না বলে জানিয়েছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। তাঁরা বলছেন, ম্যাগাজিন প্রকাশিত না হলেও বছরে ৬০ টাকা নেওয়া হয়। নবীনবরণ, কমনরুম, নৈশপ্রহরীসহ বিবিধ খাতে টাকা নেওয়া হয়।

এ বিষয়ে অভিভাবকদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের জুলাইয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) নির্দেশে তদন্ত করেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সেহেলী ফেরদৌস। ওই তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শিক্ষা বোর্ডের পরিপত্র অনুযায়ী ৯টি খাতে ৫৮৬ টাকা প্রতি শিক্ষার্থীর কাছ থেকে গ্রহণ করতে পারে। সেখানে ২০টি খাতে বছরের শুরুতে ১ হাজার ৮৯৬ টাকা গ্রহণ করা হয়েছে। আদায়কারীর স্বাক্ষর ছাড়াই বেতন কার্ডের মাধ্যমে এসব টাকা আদায় করা হয়।

এ বিষয়ে প্রধান শিক্ষক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, খাতভিত্তিক তো টাকা সব সময় ব্যয় করা হয় না। এক খাতের টাকা অন্য খাতেও ব্যয় করতে হয়। অন্যান্য বিদ্যালয়ও এভাবেই তো টাকা গ্রহণ করে।

‘ডাইনামিক সফটওয়্যারে’ টাকা লোপাট

বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর অনুপস্থিতির তথ্য, পরীক্ষার ফলসহ নানা তথ্য অভিভাবকের মুঠোফোনে খুদে বার্তার মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়ার জন্য ‘ডাইনামিক সফটওয়্যার’ চালু রয়েছে। এ জন্য ‘পথের ঠিকানা’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ২০১৮ সালে বিদ্যালয়ের চুক্তি হয়। এ জন্য শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে প্রতি মাসে ২০ টাকা করে আদায় করা হচ্ছে।

অথচ যশোর সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এই সুবিধা পেতে কোনো খরচ করতে হয় না। যশোর সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নারায়ণ চন্দ্র সাহা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা শিক্ষার্থীপ্রতি দুই টাকা করে পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে পরিশোধ করি। তবে এর জন্য শিক্ষার্থীর কাছ থেকে মাসিক কোনো টাকা নেওয়া হয় না।’

জানতে চাইলে প্রধান শিক্ষক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘বেশি টাকা দেওয়া হচ্ছে, বুঝতে পেরে আমরা ২০২২ সালের জুলাই মাস থেকে টাকা পরিশোধ বন্ধ রেখেছি।’
বিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালের আক্টোবর থেকে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সফটওয়্যার পরিচালনার জন্য ৯ লাখ ৫৩ হাজার ৫৬৪ টাকা ব্যয় করা হয়েছে।

নির্মাণকাজেও অনিয়মের অভিযোগ

বিদ্যালয়ে টয়লেট ও অভ্যন্তরে ইটের রাস্তা নির্মাণের জন্য ২০ লাখ টাকার কাজ চলমান। সেখানে পুরোনো ইট ব্যবহার করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। নির্মাণকাজের তদারকির দায়িত্বে থাকা সহকারী শিক্ষক উজ্জ্বল কুমার বিশ্বাস বলেন, তাঁকে তদারকির দায়িত্ব দেওয়া হলেও কাজের শিডিউল দেওয়া হয়নি। পরে মান নিয়ে প্রশ্ন উঠলে শিক্ষা প্রকৌশলী অধিদপ্তর থেকে তদন্ত দল কাজ দেখতে আসে। তখন জানতে পারেন, নতুন ইট দিয়ে কাজ করার কথা। সেখানে বিদ্যালয়ের আগের শৌচাগারের পুরোনো ইট দিয়ে রাস্তার কাজ করা হয়েছে। নতুন করে শৌচাগারের সুয়ারেজ ট্যাংক ও এক হাজার লিটার পানির ট্যাংক দেওয়ার কথা থাকলেও তা দেওয়া হয়নি। এখন সেগুলো নতুন করে সংযুক্ত করা হচ্ছে।

এ বিষয়ে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর যশোরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. হাদিউজ্জমান বলেন, নির্মাণকাজ এখনো চলমান। পুরোনো ইট দিয়ে শৌচাগার নির্মাণ করা হয়নি। হয়তো রাস্তায় কিছু পুরোনো ইট ব্যবহৃত হতে পারে।

ঝিকরগাছা উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. কামরুজ্জামান বলেন, বিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর ইউএনও শিক্ষা অধিদপ্তরের উপপরিচালকের কাছে পাঠিয়েছেন। এ ছাড়া ইউএনওর পক্ষ থেকে গঠন করা কমিটির তদন্ত চলমান।